রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি চূড়ান্ত করলো এনপিসিবিএল

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনতে চূড়ান্ত চুক্তি করল বাংলাদেশ: জ্বালানি নিরাপত্তায় নতুন দিগন্ত. ছবি: ডেইলি ষ্টার
ইতিহাস গড়া রূপপুর প্রকল্পে চূড়ান্ত বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনে একটি নতুন অধ্যায় রচনা হলো রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের মাধ্যমে। সদ্য চূড়ান্ত হওয়া চুক্তি অনুযায়ী, রূপপুর প্রকল্প থেকে বিদ্যুৎ কিনবে ন্যাশনাল পাওয়ার কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেড (NPCBL)। চুক্তি অনুযায়ী, প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ কিনতে সরকারকে গুণতে হবে মাত্র ৪.৭১ টাকা। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে এ মূল্য তুলনামূলকভাবে কম এবং টেকসই।
এই প্রকল্পটি বাংলাদেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র হওয়ায়, এর সফল বাস্তবায়ন দেশের জ্বালানি খাতে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আনবে। শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিক থেকেই নয়, বরং জ্ঞান, প্রযুক্তি এবং দক্ষ মানবসম্পদের দিক থেকেও এটি বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
১২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি ইউনিট
রূপপুর প্রকল্পে মোট দুটি ইউনিট থাকবে, প্রতিটির উৎপাদন ক্ষমতা ১২০০ মেগাওয়াট। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, মোট ২,৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ হবে জাতীয় গ্রিডে, যা দেশের বিদ্যুৎ সংকট দূর করতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। এই প্রকল্প থেকে পাওয়া বিদ্যুৎ হবে স্থিতিশীল, নিরবচ্ছিন্ন এবং পরিবেশবান্ধব।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, অন্যান্য তেল-গ্যাস নির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রের তুলনায় পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ অনেকটাই কম এবং এটি পরিবেশে কার্বন নিঃসরণ ঘটায় না। তাই রূপপুর প্রকল্প শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নয়, পরিবেশগত দিক থেকেও একটি স্মার্ট বিনিয়োগ।
রাশিয়ার রোসাটমের প্রযুক্তিগত সহায়তা
এই প্রকল্পটি নির্মাণ ও প্রযুক্তি সরবরাহে নেতৃত্ব দিচ্ছে রাশিয়ার রোসাটম – একটি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান। তারা শুধু প্রকল্প নির্মাণেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং বাংলাদেশি প্রকৌশলীদের প্রশিক্ষণ, নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা, এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রযুক্তিগত সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশের জ্ঞানভিত্তিক ও প্রযুক্তিনির্ভর উন্নয়নেও এটি সহায়ক হবে।
রোসাটমের সহায়তায় বাংলাদেশ এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী পারমাণবিক জ্বালানি সক্ষম দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। এটি দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক ও বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

ছবি: ডেইলি ষ্টার
দীর্ঘ পরিকল্পনার বাস্তব রূপ
২০০৯ সালে এই প্রকল্পের পরিকল্পনা গৃহীত হয়। বহু বছর ধরে পরিকল্পনা, অনুমোদন, নকশা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার পর অবশেষে প্রকল্পটি এখন বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে। এ ধরনের দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প বাস্তবায়নে যেমন ধৈর্য ও প্রতিশ্রুতি দরকার, তেমনি প্রয়োজন আন্তর্জাতিক মানের নিরাপত্তা ও দক্ষ ব্যবস্থাপনা।
সরকারি সূত্র মতে, বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হলে তা পর্যায়ক্রমে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে এবং ধাপে ধাপে দেশব্যাপী সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে। এর ফলে সাম্প্রতিক সময়ে ঘনঘন লোডশেডিং-এর মতো সমস্যাও অনেকাংশে কমে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
দেশের জ্বালানি নিরাপত্তায় নতুন যুগের সূচনা
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশ কেবলমাত্র বিদ্যুৎ উৎপাদনে নয়, বরং জ্বালানি নিরাপত্তা অর্জনের ক্ষেত্রেও এক নতুন যুগে প্রবেশ করতে চলেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের বড় একটি অংশ প্রাকৃতিক গ্যাস ও কয়লার ওপর নির্ভরশীল, যেগুলো সীমিত এবং আমদানি-নির্ভর। পারমাণবিক শক্তির মাধ্যমে এই নির্ভরতা কমে আসবে এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে দীর্ঘমেয়াদি বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি নির্ভরযোগ্য ও সাশ্রয়ী জ্বালানি অবকাঠামো তৈরি করতে পারমাণবিক বিদ্যুৎ অপরিহার্য হয়ে উঠছে।
রূপপুর প্রকল্পের প্রভাব সমাজ ও অর্থনীতিতে
শুধু বিদ্যুৎ নয়, রূপপুর প্রকল্প স্থানীয় অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। প্রকল্প এলাকায় হাজার হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরও প্রযুক্তিনির্ভর কর্মক্ষেত্র তৈরি হবে। স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সাথে রোসাটম-এর সমঝোতা প্রকল্প সংশ্লিষ্ট মানুষের দক্ষতা বৃদ্ধিতে অবদান রাখছে।
এর পাশাপাশি, ভবিষ্যতে এই প্রকল্প কেন্দ্র করে পারমাণবিক প্রযুক্তিনির্ভর আরও শিল্প গড়ে উঠতে পারে – যা বাংলাদেশের জন্য একেবারে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে পারে।
উপসংহার
বাংলাদেশের জন্য রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প কেবল একটি বিদ্যুৎ প্রকল্প নয়, বরং এটি ভবিষ্যৎ উন্নয়নের রূপরেখা। সফল বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে সরকার, আন্তর্জাতিক সহযোগী প্রতিষ্ঠান এবং জনসাধারণের মধ্যে সমন্বয় থাকা অত্যন্ত জরুরি। বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ, প্রযুক্তি বিকাশ, ও জ্বালানি নিরাপত্তা অর্জনের লক্ষ্যে রূপপুর প্রকল্প যে ভূমিকা রাখতে চলেছে তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে।