রোহিঙ্গা সংকট ঘনীভূত, তহবিল সংকটে মানবিক সহায়তা চরম হুমকিতে

রোহিঙ্গা সংকট আরও বিপজ্জনক রূপ নিচ্ছে তহবিল সংকটের কারণে। খাদ্য, চিকিৎসা ও শিক্ষা সংকটে কক্সবাজারের ক্যাম্পে মানবিক বিপর্যয় ঘটছে। ছবিঃ দ্যা ডেইলি ষ্টার
রোহিঙ্গা সংকট ঘনীভূত হচ্ছে তহবিল সংকটে
২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের ফলে প্রাণ বাঁচাতে প্রায় ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। তাদের আশ্রয় দেওয়া হয় কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে স্থাপিত ক্যাম্পে। বিগত কয়েক বছরে রোহিঙ্গাদের জীবনযাপন আন্তর্জাতিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। কিন্তু সম্প্রতি বিভিন্ন দাতা দেশের আগ্রহ কমে যাওয়া এবং অন্যান্য বৈশ্বিক সংকটে (যেমন ইউক্রেন যুদ্ধ, গাজা সংঘাত) আন্তর্জাতিক সহায়তা ছাঁটাই হওয়ায় রোহিঙ্গাদের মানবিক পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। এতে রোহিঙ্গা সংকট এখন আর শুধু একটি জাতীয় সমস্যা নয়, বরং একটি বৈশ্বিক মানবিক চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে।
খাদ্য সংকট: ক্ষুধার্ত শিশু, অপুষ্ট দেহ
বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (WFP) ঘোষণা দিয়েছে যে, বাজেট সংকটের কারণে তারা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য খাদ্য সহায়তা কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। এক সময় একজন রোহিঙ্গা প্রতিদিন প্রায় ১২ ডলারের খাদ্য সহায়তা পেত, বর্তমানে তা কমে মাত্র ৮ ডলার বা তারও কমে নেমে এসেছে। ফলে অধিকাংশ পরিবার দিনে একবার খেয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে। শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি বেড়েই চলেছে। অনেক মা পুষ্টিকর খাবার না পাওয়ায় বুকের দুধ দিতে পারছেন না, ফলে শিশুরা দুর্বল হয়ে পড়ছে। ক্যাম্পে প্রতিদিন খাদ্যের জন্য হাহাকার শোনা যায়, আর বিভিন্ন পরিবার বেঁচে থাকার জন্য বিকল্প উৎস খুঁজে নিতে বাধ্য হচ্ছে।
চিকিৎসা সংকটে মৃত্যু ঝুঁকিতে হাজারো রোহিঙ্গা
রোহিঙ্গা সংকটের আরেক ভয়াবহ দিক হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা সংকট। বহু আন্তর্জাতিক এনজিও ফান্ড না পেয়ে তাদের স্বাস্থ্য প্রকল্প বন্ধ বা সীমিত করেছে। ফলে এখন চিকিৎসা সেবায় মারাত্মক ঘাটতি দেখা দিয়েছে। অনেক রোগী প্রাথমিক চিকিৎসা না পাওয়ায় মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে, কেউ কেউ মৃত্যুবরণও করছে। বিশেষ করে গর্ভবতী নারী ও নবজাতকরা ঝুঁকির মুখে পড়েছে। সংক্রমণজনিত রোগ, ডায়রিয়া, জ্বর ও চর্মরোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। চিকিৎসা ব্যতীত এ সকল রোগ সহজেই প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে, যা পুরো ক্যাম্পবাসীর জন্য হুমকিস্বরূপ।
শিক্ষাবঞ্চিত শিশুদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রায় অর্ধলক্ষাধিক শিশু রয়েছে, যারা শিক্ষা থেকে ক্রমেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। আগের তুলনায় অনেক শিক্ষাকেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে, কারণ শিক্ষকরা সম্মানী না পাওয়ায় কাজ করতে আগ্রহ হারিয়েছেন। অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম চালানো হলেও তা পর্যাপ্ত নয় এবং অনেকেই ঝরে পড়ছে। এই শিশুদের জীবনে শিক্ষার অভাব ভবিষ্যতে তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ হ্রাস করবে এবং অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেবে। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকা এই প্রজন্ম সহজেই অপরাধ ও চরমপন্থায় ঝুঁকে পড়তে পারে, যা ভবিষ্যতের জন্য আরও বড় বিপদ।

ছবিঃ ক্রিসিস গ্রুপ
অপরাধ ও চরমপন্থার ঝুঁকিতে ক্যাম্প এলাকা
যখন মৌলিক চাহিদা পূরণ হয় না, তখন মানুষের মধ্যে হতাশা, ক্ষোভ ও অসন্তোষ বাড়ে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতেও তার ব্যতিক্রম নয়। খাদ্য ও চিকিৎসা সংকট, শিক্ষার অভাব এবং কর্মসংস্থানের অনুপস্থিতি এই জনগোষ্ঠীকে অপরাধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ক্যাম্পে চুরি, ছিনতাই, নারী পাচার এবং মাদক ব্যবসা বেড়েছে বলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রে জানা গেছে। অনেক তরুণ প্রতারণা, সহিংসতা এবং চরমপন্থী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। এই পরিস্থিতি কেবল ক্যাম্প নয়, বরং আশপাশের এলাকাগুলোর জন্যও হুমকি সৃষ্টি করছে। নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিস্থিতি এখনই নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে ভবিষ্যতে তা আরও গুরুতর আকার ধারণ করতে পারে।
আন্তর্জাতিক সহায়তা ছাড়া সমাধান অসম্ভব
বাংলাদেশ সরকার বারবার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে সাহায্যের আবেদন জানিয়ে এসেছে। কিন্তু সাহায্যের অঙ্গীকার যতটা হয়েছে, বাস্তবে তা বাস্তবায়িত হয়নি। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও আশ্বস্ত করেছে, কিন্তু বাজেট ঘাটতি এবং অন্যান্য বৈশ্বিক ইস্যুর কারণে অনেক দেশ রোহিঙ্গা ইস্যু থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। এমন অবস্থায় কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে মানবিক বিপর্যয় ঘটছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সংকট মোকাবেলায় একটি সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ছাড়া রোহিঙ্গা সংকটের কোনো স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়।
টেকসই প্রত্যাবাসনই চূড়ান্ত সমাধান
রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হলো তাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন। বাংলাদেশ সরকার ও আন্তর্জাতিক মহল বারবার মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নিয়েছে, তবে এখন পর্যন্ত তা সফল হয়নি। তহবিল সংকটের পাশাপাশি যদি প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়, তাহলে রোহিঙ্গা সংকট আরও দীর্ঘস্থায়ী হয়ে উঠবে। এ জন্য মিয়ানমারের ওপর কূটনৈতিক চাপ বাড়ানো, আন্তর্জাতিক আদালতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচারের উদ্যোগ এবং রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরার নিশ্চয়তা দেওয়া একান্ত প্রয়োজন। না হলে, শুধু বাংলাদেশ নয়, বরং পুরো অঞ্চলের জন্য এটি নিরাপত্তা ও মানবাধিকার সমস্যায় পরিণত হবে।