সংসদের অধীনে আসছে কর ছাড়, মেয়াদ সর্বোচ্চ ৫ বছর

কর ছাড় নীতি

২০২৫-২৬ অর্থবছর থেকে কর ছাড়ের অনুমোদন থাকবে জাতীয় সংসদের অধীনে এবং কোনো কর ছাড়ের মেয়াদ ৫ বছরের বেশি হবে না। সরকারের নতুন সিদ্ধান্তে কর ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। ছবি: রেপার্সেনটেটিনাল

বড় পরিবর্তন আসছে কর ছাড় নীতিতে

২০২৫-২৬ অর্থবছর থেকে বাংলাদেশে কর ছাড়ের অনুমোদন আর কেবলমাত্র নির্বাহী বিভাগের মাধ্যমে নয়, তা সংসদের নিয়ন্ত্রণে আনা হচ্ছে—এটি সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। আগে কর ছাড় সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলো প্রধানত জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের আওতায় থাকলেও, এ পরিবর্তনের ফলে এখন থেকে এসব ছাড় দিতে হলে সংসদের অনুমোদন লাগবে। এই সিদ্ধান্তের মূল লক্ষ্য হচ্ছে স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ হ্রাস করা, কর নীতিতে রাজনৈতিক প্রভাব কমানো এবং করদাতাদের প্রতি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।

সর্বোচ্চ মেয়াদ নির্ধারণের পেছনে যুক্তি

নতুন নীতিমালায় কর ছাড়ের মেয়াদ সর্বোচ্চ ৫ বছর নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। অতীতে অনেক প্রতিষ্ঠান কর ছাড় পাওয়ার পর একাধিকবার মেয়াদ বাড়িয়ে নিত, যার ফলে অনেকটা স্থায়ী করছাড়ে পরিণত হতো। এটি সরকারের রাজস্ব আদায়ে বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াত। এখন থেকে পাঁচ বছর পর প্রতিটি কর ছাড়ের কার্যকারিতা মূল্যায়ন করে তা নবায়ন করতে হবে। এতে করে অপ্রয়োজনীয় এবং অকার্যকর কর ছাড় বন্ধ করা যাবে এবং সঠিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হবে যে কোন খাতে কর ছাড় প্রদান করা উপযুক্ত।

সংসদের সম্পৃক্ততার অর্থ কী?

সংসদের হাতে কর ছাড়ের নিয়ন্ত্রণ চলে আসা মানে হলো, কর নীতিতে আর শুধু আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত নয়, জনগণের প্রতিনিধিদের মতামতকেও গুরুত্ব দেওয়া হবে। সংসদীয় স্থায়ী কমিটি বা বাজেট অধিবেশনে এসব ছাড় নিয়ে আলোচনা হবে এবং যৌক্তিকতা প্রমাণিত হলেই অনুমোদন মিলবে। এর ফলে কর ছাড় প্রদানের সময় স্বচ্ছতা বজায় থাকবে এবং দলীয় বা গোষ্ঠীস্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়ার ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যাবে। একইসাথে এটি জনগণের মধ্যে আস্থা সৃষ্টি করবে যে কর নীতি রাজনৈতিক প্রভাব মুক্তভাবে পরিচালিত হচ্ছে।

ব্যবসা-বিনিয়োগের উপর প্রভাব কেমন হবে?

নতুন নিয়ম চালু হলে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য কর ছাড় পাওয়ার প্রক্রিয়া কিছুটা সময়সাপেক্ষ ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে উঠবে। কিছু বিনিয়োগকারী দীর্ঘমেয়াদী কর ছাড় না পেয়ে উদ্বিগ্ন হতে পারেন। তবে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশে ব্যবসায়িক পরিবেশে ভারসাম্য আনবে এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে দেশের কর প্রশাসনকে আরও বিশ্বাসযোগ্য হিসেবে তুলে ধরবে। কর ছাড় নবায়নের সুযোগ থাকলেও তা হবে যাচাই-বাছাই ও ফলাফল বিশ্লেষণের ভিত্তিতে, যা ব্যবসায়িক খাতে বাস্তবিক মূল্যায়নকেই গুরুত্ব দেবে।

বাংলাদেশ অর্থনীতি,

ছবি: বিসনেস স্টান্ডের

অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের প্রতিক্রিয়া

দেশের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদরা এই উদ্যোগকে সময়োপযোগী ও প্রয়োজনীয় বলেই উল্লেখ করেছেন। তাদের মতে, বহুদিন ধরেই কর ছাড়ের অপব্যবহার, স্বজনপ্রীতি এবং স্বচ্ছতার অভাবে দেশের রাজস্ব ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। নতুন এই সংসদীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কার্যকরভাবে এসব সমস্যার সমাধানে ভূমিকা রাখবে। তাঁরা আরও সুপারিশ করেছেন, কর ছাড় মূল্যায়নের জন্য একটি স্বাধীন ‘কর ছাড় মূল্যায়ন কমিশন’ গঠনের, যা স্বচ্ছ ও পক্ষপাতহীন রিপোর্ট সরকারের কাছে দেবে এবং সেই রিপোর্টের ভিত্তিতেই নবায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

ভবিষ্যৎ কর সংস্কারে সরকারের পরিকল্পনা

সরকার বর্তমানে কর প্রশাসনে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার, করদাতাদের সেবা সহজীকরণ এবং কর ফাঁকি রোধে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে। কর ছাড়ের মেয়াদ নির্ধারণ ও সংসদীয় নিয়ন্ত্রণ সংযোজন, এই বৃহৎ কর সংস্কার প্রক্রিয়ারই একটি অংশ। এর মাধ্যমে সরকারের উদ্দেশ্য হলো, এমন একটি কর ব্যবস্থা গড়ে তোলা যেখানে সবার জন্য নিয়ম এক, বিশেষ সুবিধা বা পক্ষপাতিত্ব থাকবে না, এবং রাজস্ব প্রবাহ হবে স্থিতিশীল ও পূর্বাভাসযোগ্য। এটি আগামী বাজেটে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করবে যে, বাংলাদেশ এখন উন্নততর অর্থনৈতিক শাসন ব্যবস্থার পথে হাঁটছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *