সাংবাদিকতায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো সময়ের দাবি

সাংবাদিকতায় নারী

নারীদের সংবাদমাধ্যমে অংশগ্রহণ এখনো সীমিত। নিরাপদ কর্মপরিবেশ, প্রশিক্ষণ ও সুযোগের মাধ্যমে সাংবাদিকতায় নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। ছবিঃ প্রথম আলো

সাংবাদিকতায় নারীর অংশগ্রহণ: সময়ের দাবি

বর্তমান বিশ্বে নারীর ক্ষমতায়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়। রাজনীতি থেকে শুরু করে প্রযুক্তি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য—সব ক্ষেত্রেই নারীরা আজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তবে সাংবাদিকতা খাত এখনো পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার ছাপ বহন করছে। বাংলাদেশসহ অনেক দেশে এখনো এই পেশায় নারীর অংশগ্রহণ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।

যেখানে সংবাদমাধ্যম সমাজের দর্পণ হিসেবে কাজ করে, সেখানে নারী-পুরুষের সমান প্রতিনিধিত্ব না থাকা সামাজিক ভারসাম্য রক্ষার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই সময় এসেছে সাংবাদিকতায় নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার।

সাংবাদিকতা খাতে নারীর বর্তমান অবস্থা

বাংলাদেশে কিছু প্রতিষ্ঠিত নারী সাংবাদিক থাকলেও মোট জনসংখ্যার অনুপাতে সংখ্যাটি খুবই নগণ্য। জাতীয় দৈনিকগুলোতে উপসম্পাদকীয় থেকে শুরু করে রিপোর্টিং বা নিউজরুম—প্রায় প্রতিটি বিভাগেই পুরুষদের আধিপত্য লক্ষণীয়।

বিশেষ করে মাঠপর্যায়ে রিপোর্টিং, রাজনৈতিক সাংবাদিকতা, ক্রাইম রিপোর্টিং ইত্যাদি ক্ষেত্রে নারীদের উপস্থিতি খুবই সীমিত। অনেকেই প্রতিকূল পরিবেশ, নিরাপত্তাহীনতা ও পারিবারিক চাপে এই পেশায় দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারেন না।

এ অবস্থার পরিবর্তন না হলে সংবাদমাধ্যম কখনোই সর্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিনিধিত্ব করতে পারবে না।

নারীদের কম অংশগ্রহণের পেছনে অন্তরায়

নারীদের সাংবাদিকতায় আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও কিছু প্রতিবন্ধকতা তাদের এগোতে বাধা দেয়। পরিবার ও সমাজে এখনো এই পেশাটিকে ‘পুরুষদের কাজ’ হিসেবে দেখা হয়। বিশেষ করে রাতের শিফট, ফিল্ড রিপোর্টিং ও দূরবর্তী এলাকায় কাজ করার সুযোগ কম পাওয়ার কারণে নারীরা পিছিয়ে পড়ে।

পাশাপাশি, অনেক মিডিয়া হাউজে সঠিক প্রশিক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তার অভাবও তাদের পেশাগত উন্নয়নে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে কর্মস্থলে বৈষম্য, হেনস্তা ও হয়রানির অভিযোগও উঠে আসে।

এই চিত্র শুধু বাংলাদেশে নয়—আন্তর্জাতিক পর্যায়েও অনেক দেশে একই সমস্যা বিরাজমান।

নারীর উপস্থিতি কীভাবে সাংবাদিকতাকে সমৃদ্ধ করে

একজন নারী সাংবাদিক তার দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সংবাদে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারেন। সমাজে নারী, শিশু, স্বাস্থ্য, পারিবারিক সহিংসতা, যৌন হয়রানি ইত্যাদি বিষয়ে রিপোর্ট করতে নারী সাংবাদিকদের ভ‚মিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

তারা অনেক ক্ষেত্রেই এমনসব গল্প সামনে আনেন, যা পুরুষ সহকর্মীদের কাছে অধরা থেকে যায়। এছাড়া নারীদের সমান অংশগ্রহণ সাংবাদিকতায় ব্যালান্সড ও ইনক্লুসিভ কনটেন্ট তৈরি করে, যা সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

মিডিয়ায় নারীর ভূমিকা

ছবিঃ বওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফর্ম

কীভাবে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো যেতে পারে

সাংবাদিকতায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে হলে সর্বপ্রথম কর্মস্থলে একটি নিরাপদ, সহানুভূতিশীল ও সমানাধিকারের পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে নারীবান্ধব নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে—যেমনঃ মাতৃত্বকালীন ছুটি, রাতে কাজের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা, যৌন হয়রানি প্রতিরোধ আইন বাস্তবায়ন ইত্যাদি।

তাছাড়া নারী সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ, স্কিল ডেভেলপমেন্ট ও নেতৃত্বের সুযোগ দিতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নারীদের মিডিয়া স্কলারশিপ, ইন্টার্নশিপ ও সাংবাদিকতায় ক্যারিয়ার গড়ার প্ল্যাটফর্ম আরও বিস্তৃত করতে হবে।

শিক্ষাক্ষেত্রে নারী সাংবাদিক তৈরির ভূমিকা

বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগগুলোতে নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা আশাব্যঞ্জক হলেও সেগুলো থেকে পাস করার পর পেশায় টিকে থাকার হার তুলনামূলকভাবে কম। এজন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে আরও সমন্বয় প্রয়োজন।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় থেকেই নারীদের জন্য অনুপ্রেরণামূলক প্রোগ্রাম, মেন্টরশিপ এবং বাস্তবমুখী ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা থাকলে তারা পেশায় টিকে থাকার আত্মবিশ্বাস পাবে।

জাতিসংঘ, UNESCO এবং অনেক আন্তর্জাতিক মিডিয়া সংস্থা নারীর সাংবাদিকতায় অংশগ্রহণ বাড়াতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে। বাংলাদেশেও এমন উদাহরণ তৈরি করতে হবে। মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড, সম্মাননা, ফিল্ড সাপোর্ট ও সরকারি পর্যায়ে নীতিগত সহায়তা নারীদের উৎসাহিত করতে পারে।

নতুন প্রজন্মের মেয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাংবাদিকতা পেশার প্রতি আগ্রহ তৈরি করতে স্কুল ও কলেজ স্তরে মিডিয়া এডুকেশন প্রোগ্রাম চালু করাও সময়ের দাবি।

নারী সাংবাদিকরা শুধুমাত্র সংখ্যা নয়, তারা একটি সমাজের সমতা, সহানুভূতি ও অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতীক। সংবাদমাধ্যমে তাদের সমান প্রতিনিধিত্ব না থাকলে সমাজের পূর্ণ চিত্র কখনোই তুলে ধরা সম্ভব নয়।

তাই সাংবাদিকতায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো শুধু ন্যায্যতা নয়—এটি গণতান্ত্রিক, মানবিক ও উন্নত সমাজের জন্য অপরিহার্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *