সালেহউদ্দিন আহমেদের বাজেট লক্ষ্যমাত্রা ২০২৫

পরবর্তী জাতীয় বাজেটে সালেহউদ্দিন আহমেদের নির্ধারিত বাজেট লক্ষ্যমাত্রা দেশের অর্থনীতি, কর্মসংস্থান, কৃষি ও শিক্ষায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনবে। জেনে নিন বিস্তারিত পরিকল্পনা। ছবিঃ প্রথম আলো ইংলিশ
অর্থনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপট
বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতি এক বহুমাত্রিক সংকট ও সম্ভাবনার সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব, মার্কিন ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও রিজার্ভের সংকট দেশের অর্থনীতিকে চাপে ফেলে দিয়েছে। এর পাশাপাশি দেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির অপ্রতুলতা, আমদানি নির্ভরতা এবং অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে ঘাটতির কারণে সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবাহে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আগামী বাজেট শুধুমাত্র অর্থনৈতিক রূপরেখা নয়, বরং একটি দিকনির্দেশক দলিল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। অর্থনীতিবিদ সালেহউদ্দিন আহমেদ এ প্রেক্ষাপটে যে বাজেট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন, তা একটি টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতির ভিত্তি গড়তে পারে।
কর্মসংস্থান ও উদ্যোক্তা উন্নয়নের উপর গুরুত্ব
বেকারত্ব বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি, বিশেষ করে তরুণ সমাজের মধ্যে। সালেহউদ্দিন আহমেদের বাজেট লক্ষ্যমাত্রার অন্যতম মূল স্তম্ভ হচ্ছে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন। তাঁর মতে, দেশের বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠীকে উৎপাদনশীল খাতে অন্তর্ভুক্ত করতে হলে তাদের প্রশিক্ষণ, দক্ষতা উন্নয়ন এবং আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে হবে। তিনি বাজেটে তরুণদের জন্য ‘ইউথ এন্টারপ্রেনারশিপ ফান্ড’ গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন, যেখানে স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানগুলো সহজ শর্তে ঋণ ও ভর্তুকি পাবে। পাশাপাশি নারী উদ্যোক্তাদের জন্য আলাদা বরাদ্দ এবং ব্যবসা শুরু করতে নীতিগত সহায়তা প্রদানের পরিকল্পনাও রয়েছে। এসব পদক্ষেপ দেশের উদ্যোক্তা পরিবেশকে আরও সক্রিয় করে তুলবে বলে আশা করা হচ্ছে।
কৃষিখাতে স্বনির্ভরতা অর্জনের লক্ষ্যে বরাদ্দ
সালেহউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, কৃষি খাতে বিনিয়োগ ছাড়া দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও গ্রামীণ উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই বাজেটে কৃষকদের জন্য স্বল্প সুদে ঋণ, উন্নত বীজ ও সার সরবরাহ, এবং জলবায়ু সহনশীল প্রযুক্তির সম্প্রসারণে বড় অঙ্কের বরাদ্দের কথা বলা হয়েছে। তিনি কৃষিপণ্যের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিতকরণে একটি ‘প্রাইস স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড’ গঠনের প্রস্তাবও দিয়েছেন, যা কৃষকদের দামের ওঠানামা থেকে সুরক্ষা দেবে। পাশাপাশি, কৃষিপণ্য রপ্তানি বাড়াতে বিশেষ সাবসিডি ও নীতিগত সহায়তা প্রদানের বিষয়টিও বাজেটে স্থান পাবে। এর ফলে কৃষি হবে আরও লাভজনক ও টেকসই, যা দেশের মোট জিডিপিতে বড় ধরনের অবদান রাখতে পারবে।

ছবিঃ ইন্ডাস্ট্রি ইন্সিডের
শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে টেকসই বরাদ্দ
সালেহউদ্দিন আহমেদের বাজেট লক্ষ্যমাত্রায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে মানবসম্পদ উন্নয়নের প্রধান চালিকা শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। তিনি শিক্ষা খাতে গবেষণা, প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষার প্রসার এবং কারিগরি শিক্ষাকে প্রাধান্য দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। পাশাপাশি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে অতিরিক্ত বরাদ্দের কথা বলা হয়েছে। স্বাস্থ্যখাতে তাঁর পরিকল্পনা আরও বিস্তৃত, যেখানে প্রত্যন্ত অঞ্চলে চিকিৎসা সেবা পৌঁছে দিতে ভ্রাম্যমাণ মেডিকেল ইউনিট, টেলিমেডিসিন এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোর আধুনিকায়নের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে নতুন মেডিকেল কলেজ, নার্সিং ইনস্টিটিউট এবং চিকিৎসা যন্ত্রপাতি আমদানিতে করছাড়ের প্রস্তাব রয়েছে।
বৈদেশিক বিনিয়োগ আহরণে কৌশল
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক বিনিয়োগ একটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি। সালেহউদ্দিন আহমেদ এই বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে বেশ কিছু কৌশলগত পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। যেমন, অর্থনৈতিক অঞ্চলসমূহে আন্তর্জাতিক মানের অবকাঠামো নির্মাণ, বিনিয়োগকারীদের জন্য কর-ছাড় সুবিধা এবং ‘ইজ অফ ডুয়িং বিজনেস’ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান উন্নত করতে একাধিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি বাজেটে থাকবে। বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে ডিজিটাল রেজিস্ট্রেশন ও অনলাইন লাইসেন্সিং পদ্ধতির উন্নয়ন, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার উপরও তিনি গুরুত্বারোপ করেছেন। এই পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়িত হলে প্রযুক্তি, উৎপাদন ও পরিসেবা খাতে নতুন বিনিয়োগ আসবে এবং তা কর্মসংস্থান ও রাজস্ব বৃদ্ধিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।
রাজস্ব সংগ্রহে নতুন কৌশল
জাতীয় বাজেট বাস্তবায়নে রাজস্ব আহরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে বর্তমানে এনবিআর কাঠামো দুর্বল, কর জিডিপি অনুপাত কম এবং কর আদায়ে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। সালেহউদ্দিন আহমেদের বাজেট পরিকল্পনায় রাজস্ব সংগ্রহে মৌলিক সংস্কার আনার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। তিনি আয়কর কাঠামোতে নিম্নআয়ের জনগণের জন্য করছাড় বাড়ানোর পাশাপাশি উচ্চআয়ের করদাতাদের ক্ষেত্রে যথাযথ কর আদায়ের ওপর জোর দিয়েছেন। অটোমেশন ও ডিজিটাল কর ব্যবস্থার প্রসারে বাড়তি বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এছাড়া, ভ্যাট ব্যবস্থার সংস্কার এবং অপ্রদর্শিত আয়ের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতিও রয়েছে তাঁর পরিকল্পনায়। এর ফলে রাজস্ব প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে এবং বাজেট ঘাটতি মোকাবিলা সহজ হবে।
টেকসই উন্নয়ন ও পরিবেশ সংরক্ষণ
পরিবেশ রক্ষায় সচেতন ও দায়িত্বশীল বাজেট প্রণয়নের উপর সালেহউদ্দিন আহমেদ জোর দিয়েছেন। টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ, শহরাঞ্চলে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন এবং বনাঞ্চল সংরক্ষণের জন্য বাজেটে আলাদা বরাদ্দ থাকবে বলে জানা গেছে। একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় গৃহীত হবে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ, যেমন- উপকূলীয় এলাকায় বন্যা প্রতিরোধ অবকাঠামো গড়ে তোলা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং পরিবেশবান্ধব শিল্প স্থাপনে উৎসাহ। এসব উদ্যোগের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ ও বাসযোগ্য দেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখা হচ্ছে।