সুদানের গৃহযুদ্ধে পরিবর্তন: আরএসএফ ও আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতি

RSF

সুদানের গৃহযুদ্ধ এখন আন্তর্জাতিক রূপ নিচ্ছে। আরএসএফ-এর সামরিক সাফল্য, বৈদেশিক সমর্থন এবং ক্রমবর্ধমান মানবিক সংকট সুদানের ভবিষ্যৎকে গভীর অনিশ্চয়তার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ছবি: ফেয়ার অবসাবের

আরএসএফ-এর উত্থান ও সামরিক ভারসাম্যের বিপর্যয়

সুদানের গৃহযুদ্ধ শুরু হয় ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে, যার মূল দ্বন্দ্ব গড়ে ওঠে দেশের সেনাবাহিনী (SAF) এবং আধাসামরিক বাহিনী র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (RSF)-এর মধ্যে। যুদ্ধের শুরুর দিকে রাজধানী খার্তুমে SAF কিছুটা নিয়ন্ত্রণ রাখলেও দ্রুত আরএসএফ বিস্তার লাভ করে, বিশেষত পশ্চিম দারফুর অঞ্চলে। হেমেদতি-র নেতৃত্বে আরএসএফ একটি সুসংগঠিত, দ্রুতগামী বাহিনীতে পরিণত হয়, যারা স্থানীয় মাটি এবং রাজনীতির সুবিধা নিয়ে সাফল্যের সাথে অগ্রসর হয়েছে। বিশেষ করে দারফুর অঞ্চলে তারা SAF-কে একাধিক বার প্রতিহত করে এবং প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণও গ্রহণ করে।

আন্তর্জাতিক শক্তির পেছনের ভূমিকা ও ভূরাজনৈতিক সমীকরণ

সুদানের গৃহযুদ্ধ শুধুমাত্র অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়, বরং এটি একটি ভূরাজনৈতিক সংঘর্ষেও রূপ নিয়েছে। আরএসএফ পেছনে রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত (UAE)-এর মতো অর্থনৈতিক শক্তিধর রাষ্ট্র, যারা চাদের ভেতর দিয়ে অস্ত্র এবং সামরিক সরঞ্জাম পাঠানোর অভিযোগের মুখোমুখি। একইসঙ্গে রাশিয়ার ওয়াগনার গ্রুপও তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়েছে বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

অন্যদিকে, সুদানের সরকারি বাহিনী SAF-এর পাশে রয়েছে মিশর ও ইরানের মত আঞ্চলিক শক্তি। ইরান ড্রোন ও সামরিক পরামর্শদাতা সরবরাহ করছে, যা SAF-এর শক্তি পুনর্গঠনে ভূমিকা রাখছে। এই বৈদেশিক জটিলতা সংঘাতকে দীর্ঘস্থায়ী এবং জটিল করে তুলেছে।

মানবিক বিপর্যয়: সংখ্যায় নয়, কষ্টে বোঝা যায় প্রকৃত অবস্থা

এই যুদ্ধ সুদানের সাধারণ মানুষের উপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে। জাতিসংঘের তথ্যমতে, এযাবৎ প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ৩৫ লাখ মানুষ দেশ ছেড়ে প্রতিবেশী দেশে আশ্রয় নিয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নারী ও শিশু। শুধু অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত জনগণের মধ্যে প্রায় ৫৩% শিশু, যারা এখন শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত।

এছাড়াও, খাদ্য ও পানির চরম সংকট দেখা দিয়েছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির তথ্যমতে, বহু এলাকা রীতিমতো অনাহারে ভুগছে এবং অনেক পরিবার দিনের পর দিন সামান্য খাবারে বেঁচে আছে। এই পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যাচ্ছে।

সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধ্বংস ও জাতিগত সহিংসতা

যুদ্ধের ভয়াবহতা শুধু মানুষে থেমে নেই, এটি ছুঁয়ে গেছে সুদানের ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে। দেশটির প্রাচীন ঐতিহাসিক স্থান যেমন নাকা, মুসাওয়ারাত এস-সুফরা এবং সুলতান আলী দিনারের প্রাসাদ বোমা হামলার ফলে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। UNESCO ঘোষিত এই ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলোর ধ্বংস সুদানের ঐতিহ্যিক ও পরিচয়কে ধ্বংস করছে।

এছাড়াও, যুদ্ধের আড়ালে জাতিগত সহিংসতা বেড়েই চলেছে। দারফুর অঞ্চলে বিশেষ কিছু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত সহিংসতা এবং গণহত্যার অভিযোগও উঠেছে, যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও শান্তির সম্ভাবনা

বিশ্ব সম্প্রদায় এখনো একটি কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। জাতিসংঘ এবং আফ্রিকান ইউনিয়নের পক্ষ থেকে একাধিকবার শান্তি আলোচনা শুরু করার চেষ্টা করা হলেও সেগুলো ফলপ্রসূ হয়নি। কারণ, উভয় পক্ষই নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে চায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলো আন্তরিকভাবে শান্তির জন্য এগিয়ে না আসে, তাহলে সুদানে একটি দীর্ঘমেয়াদী গৃহযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠবে।

সামনে কী?

সুদানের বর্তমান পরিস্থিতি এক গভীর অচলাবস্থায় আটকে গেছে। আরএসএফ সামরিকভাবে সফল হলেও, মানবিকভাবে এটি দেশটিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এই যুদ্ধ যত দীর্ঘ হবে, তত বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তত বেশি সংস্কৃতি হারিয়ে যাবে এবং তত বেশি আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হবে।

সুদানের জনগণ এখন একটি প্রশ্নের মুখে: তারা কি শুধুই বড় শক্তির খেলায় একটি ঘুঁটি, নাকি তাদের জন্য সত্যিকার পরিবর্তন আসবে? এই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করছে বিশ্ব সম্প্রদায়ের নৈতিক ও মানবিক দায়িত্ববোধের উপর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *