সুশাসন ও জবাবদিহিতা: প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি

সুশাসন ও জবাবদিহিতা একটি কার্যকর রাষ্ট্র পরিচালনার ভিত্তি। প্রশাসনের স্বচ্ছতা, জনগণের অংশগ্রহণ ও দুর্নীতি রোধে কীভাবে এগুলো কার্যকর ভূমিকা রাখে, তা জানুন বিস্তারিতভাবে। ছবিঃ নিউ এইজ
গণতান্ত্রিক সমাজের মৌলিক ভিত্তি
সুশাসন (Good Governance) এবং জবাবদিহিতা (Accountability) একটি আধুনিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালনার মূল ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত। একটি রাষ্ট্র তখনই জনগণের কল্যাণে কাজ করতে পারে, যখন প্রশাসন কার্যকর, স্বচ্ছ এবং জনগণের জবাবদিহিতার আওতায় থাকে। সুশাসন মানে শুধু নীতিমালা থাকা নয়, বরং তার বাস্তবায়নে ন্যায়বিচার, দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। অপরদিকে, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে যে রাষ্ট্রের প্রতিটি পর্যায়ের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছে কিনা তা জনগণের সামনে ব্যাখ্যা দিতে বাধ্য। এই দুই নীতির অভাবে কোনো রাষ্ট্র দীর্ঘমেয়াদে উন্নয়নের পথে এগোতে পারে না।
প্রশাসনের দক্ষতা বৃদ্ধিতে সুশাসনের অপরিহার্যতা
সুশাসন কেবল রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণ পর্যায়ে নয়, বরং প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে কার্যকারিতাকে ত্বরান্বিত করে। যে কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নে, যেমন—অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষা বা স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ ও সেবা প্রদানে যদি সুশাসনের চর্চা থাকে, তাহলে জনগণ সরাসরি উপকৃত হয়। উদাহরণস্বরূপ, যদি স্থানীয় সরকার প্রকল্পগুলোতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বজায় থাকে, তাহলে সেগুলো সময়মতো ও সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়। এছাড়া, প্রশাসনিক জবাবদিহিতা না থাকলে তহবিলের অপব্যবহার, স্বজনপ্রীতি বা অব্যবস্থাপনার সৃষ্টি হয়, যা সরাসরি সাধারণ নাগরিকদের ক্ষতিগ্রস্ত করে।
জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া সুশাসন অসম্পূর্ণ
সুশাসনের প্রধান শর্ত হলো জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ। কেবলমাত্র কেন্দ্র বা স্থানীয় প্রশাসনের সিদ্ধান্তে নয়, বরং জনগণ যদি নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় মতামত দিতে পারে, তাহলে প্রশাসনের কাজ হয় আরও বাস্তবমুখী ও জনমুখী। তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার এই অংশগ্রহণের সুযোগকে আরও প্রসারিত করেছে। আজকাল অনলাইনে বাজেট খসড়া প্রকাশ, অভিযোগ দায়েরের ডিজিটাল পদ্ধতি এবং উন্মুক্ত ফোরামে মতামত প্রদানের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ সরাসরি রাষ্ট্রের কর্মকাণ্ডে যুক্ত হচ্ছে। এভাবেই গঠিত হয় জনগণের সরকার, যা সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্রের প্রতিফলন।
দুর্নীতি রোধে জবাবদিহিতার শক্তিশালী ভূমিকা
দুর্নীতি একটি রাষ্ট্রের জন্য অন্যতম বড় অন্তরায়, যা সুশাসনের অভাবেই জন্ম নেয়। যদি কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা তাদের কার্যক্রমের জন্য কারো কাছে জবাবদিহি না করে, তবে তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে স্বার্থ হাসিল করতে পারে। কিন্তু যখন প্রশাসন স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক হয়, তখন কোনো ধরনের অনিয়ম দ্রুতই চিহ্নিত হয়ে প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়। বাংলাদেশে যেমন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), অডিট বিভাগ ও তথ্য অধিকার আইন আছে, সেগুলোর কার্যকর প্রয়োগ হলে জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়। এইসব পদক্ষেপ দুর্নীতি রোধে দীর্ঘমেয়াদে সুফল বয়ে আনে।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDGs) ও সুশাসনের সম্পৃক্ততা
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDGs)-র মধ্যে ১৬ নম্বর লক্ষ্য “শান্তি, ন্যায়বিচার ও শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান” প্রতিষ্ঠা করা। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য সুশাসন ও জবাবদিহিতার অনুশীলন অত্যন্ত জরুরি। সুশাসন নিশ্চিত হলে শুধু প্রশাসনিক দক্ষতাই বৃদ্ধি পায় না, বরং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটে। এটি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ায়, আন্তর্জাতিক সহায়তা বাড়াতে ভূমিকা রাখে এবং দেশের ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিকভাবে উজ্জ্বল করে তোলে।