পুতিনের আলোচনার প্রস্তাব কি পশ্চিমা ঐক্য ভাঙার কৌশল?

ভ্লাদিমির পুতিন

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের আলোচনার প্রস্তাবের পেছনে কৌশলগত উদ্দেশ্য থাকতে পারে বলে মত প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষক স্টিভ রোজেনবার্গ। এটি কি আমেরিকা ও ইউরোপের মধ্যে ফাটল ধরানোর পরিকল্পনা? জানুন বিস্তারিত। ছবিঃ বিবিসি

আলোচনার প্রস্তাব: পুতিনের নতুন কৌশল?

সম্প্রতি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন একটি আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছেন যা ইউক্রেন সংঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধানের ইঙ্গিত হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এটি কেবল একটি সাধারণ প্রস্তাব নয়—বরং এর পেছনে রয়েছে গভীর কৌশল। বিবিসির রাশিয়া বিষয়ক সংবাদদাতা স্টিভ রোজেনবার্গ তার সাম্প্রতিক বিশ্লেষণে জানিয়েছেন, পুতিনের এই প্রস্তাব আসলে পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে আমেরিকা ও ইউরোপের মধ্যে মতপার্থক্য সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে দেওয়া হতে পারে। তিনি বলেছেন, “এই আলোচনা আহ্বানের মাধ্যমে পুতিন সম্ভবত একপক্ষকে প্রলুব্ধ করে অন্য পক্ষকে দুর্বল করার চেষ্টা করছেন।”

ইউক্রেন যুদ্ধ ও পশ্চিমা ঐক্য: এক জটিল সমীকরণ

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই পশ্চিমা দেশগুলো—বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য রাষ্ট্রগুলো—একত্রিতভাবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তারা ইউক্রেনকে সামরিক, আর্থিক ও কূটনৈতিকভাবে সহায়তা দিয়ে চলেছে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে ইউরোপের অভ্যন্তরে যুদ্ধের দীর্ঘস্থায়িত্ব, অর্থনৈতিক চাপ এবং জ্বালানি সংকট নিয়ে বিভাজনের সুর শোনা যাচ্ছে। এই অবস্থায় পুতিন যদি কোনো আলোচনার টোপ ছুঁড়ে দেয়, তবে ইউরোপের কিছু দেশ তা গ্রহণে আগ্রহী হতে পারে, যা যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে। রোজেনবার্গের মতে, এটিই পুতিনের প্রধান লক্ষ্য হতে পারে।

স্টিভ রোজেনবার্গের বিশ্লেষণ: ঐক্য ভাঙার এক সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা

বিবিসির সাংবাদিক স্টিভ রোজেনবার্গ দীর্ঘদিন ধরে রাশিয়ায় অবস্থান করে রিপোর্টিং করে আসছেন এবং তিনি পুতিন প্রশাসনের কৌশলগত মনোভাব সম্পর্কে গভীর অন্তর্দৃষ্টি রাখেন। তার মতে, পুতিন এমন এক সময় এই আলোচনার কথা তুলেছেন যখন ইউরোপ জ্বালানি সংকট, অর্থনৈতিক চাপ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতায় ভুগছে। অনেক দেশেই সরকার পরিবর্তন হচ্ছে, জনমনে যুদ্ধের প্রতি বিরক্তি বাড়ছে। ঠিক এই সময় একটি আলোচনার প্রস্তাব দিয়ে পুতিন ইউরোপকে বিভক্ত করার কৌশল নিচ্ছেন, যাতে কিছু দেশ শান্তি চুক্তির পক্ষে অবস্থান নেয় এবং আমেরিকার নেতৃত্বাধীন জোট দুর্বল হয়। রোজেনবার্গ বলেন, “পুতিন জানেন, স্নায়ু যুদ্ধের সময়েও এমন কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে—এবারও তার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।”

ইউরোপীয় প্রতিক্রিয়া: মতপার্থক্যের ইঙ্গিত?

ইতোমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন সদস্য দেশের প্রতিক্রিয়ায় ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে। ফ্রান্স ও জার্মানির মতো কিছু দেশ শান্তিপূর্ণ সমাধানের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব দেখালেও, পোল্যান্ড, বাল্টিক দেশগুলো এবং যুক্তরাজ্য অনেকটাই কঠোর অবস্থানে রয়েছে। তারা মনে করে, রাশিয়া যুদ্ধ বন্ধ না করে আলোচনা চায় শুধুমাত্র সময় ক্ষেপণের জন্য এবং বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতেই। এই মতপার্থক্য যদি বাড়তে থাকে, তবে তা পশ্চিমা ঐক্যকে সত্যিই দুর্বল করতে পারে, যা পুতিনের পক্ষে লাভজনক হবে।

স্টিভ রোজেনবার্গ

ছবিঃ দে নিউ ওয়ার্ক টাইমস

যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান: সন্দেহ ও সতর্কতা

যুক্তরাষ্ট্র এখনো রাশিয়ার প্রস্তাবকে আন্তরিক বলে মেনে নিচ্ছে না। হোয়াইট হাউজ ও পেন্টাগনের ভাষ্য অনুযায়ী, পুতিন একাধিকবার আলোচনার প্রস্তাব দিলেও সেগুলো কখনোই বিশ্বাসযোগ্যতার প্রমাণ দিতে পারেনি। বরং আলোচনা চলাকালীনই ইউক্রেনের ওপর হামলা বাড়ানো হয়েছে। তাই আমেরিকা এই আলোচনাকে কৌশলগত ফাঁদ হিসেবে দেখছে এবং ইউরোপকেও সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু ইউরোপের মধ্যে যদি কেউ ভিন্ন পথে হাঁটতে চায়, তাহলে সেই ঐক্য কীভাবে বজায় থাকবে, সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।

সামনে কী?

বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চে পুতিনের এই আলোচনার প্রস্তাব নতুন করে উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে। এটি কি সত্যিকার অর্থেই শান্তির উদ্দেশ্যে, নাকি একটি সুচতুর বিভাজনের কৌশল? স্টিভ রোজেনবার্গের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, আমাদের সবাইকে এটি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। ইউক্রেন যুদ্ধের ভবিষ্যৎ, ইউরোপ-আমেরিকার মিত্রতার স্থায়ীত্ব এবং বৈশ্বিক নিরাপত্তা—সব কিছুই এখন অনেকাংশে নির্ভর করছে এই আলোচনার প্রতিক্রিয়া ও এর পরিণতির ওপর।

পুতিনের কূটনৈতিক চালের ধারাবাহিকতা

রাশিয়ার ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ভ্লাদিমির পুতিন অতীতে বহুবার পশ্চিমা বিশ্বের ভেতরে মতভেদ তৈরি করতে সফল হয়েছেন। ২০১৪ সালে ক্রাইমিয়া দখলের পর ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ নিয়ে মতবিরোধ তৈরি হয়। জার্মানি এবং ইতালির মতো দেশগুলো শুরু থেকেই কিছুটা নরম মনোভাব দেখায়, যেখানে যুক্তরাজ্য ও পোল্যান্ড কঠোর অবস্থানে ছিল। এই ইতিহাস থেকে বোঝা যায়, পুতিন জানেন কীভাবে পশ্চিমা জোটের ভেতরের দুর্বল জায়গাগুলোকে কাজে লাগাতে হয়। বর্তমান আলোচনার প্রস্তাবও সেই ধারাবাহিক চাল হতে পারে, যেখানে তিনি নীতিগতভাবে ঐক্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চান।

রাশিয়ার আরেকটি অস্ত্র

পুতিন প্রশাসন আলোচনার প্রস্তাবকে শুধুমাত্র কূটনৈতিক পথে উপস্থাপন করছে না—রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মিডিয়া এবং সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মগুলোতেও এই বার্তাটি ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে যে রাশিয়া শান্তি চায়, কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলো যুদ্ধ জারি রাখতে চায়। এটি এক প্রকার ‘মত-প্রভাব বিস্তারের কৌশল’, যার মাধ্যমে রাশিয়া বিশ্ববাসীর কাছে নিজেকে যুক্তিসঙ্গত ও ন্যায্য পক্ষ হিসেবে তুলে ধরতে চাচ্ছে। বিশেষ করে পশ্চিমা দেশের জনগণের মধ্যে যুদ্ধবিরোধী মনোভাব বাড়ানোর জন্য এই প্রচারণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *