ডলারের বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণে কঠোর নজরদারি

বাংলাদেশে ডলারের অস্থিরতা রোধে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের সম্মিলিত কঠোর পদক্ষেপ। বৈধ রেমিট্যান্স, আমদানি নিয়ন্ত্রণ, রপ্তানি আয়, কালোবাজারি রোধসহ বিস্তারিত কার্যক্রম তুলে ধরা হয়েছে। ছবিঃ প্রথম আলো ইংলিশ
মার্কেটে ডলারের বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণে কঠোর নজরদারি
বর্তমানে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতার প্রভাবে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা বাজারেও বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে ডলারের মূল্য বৃদ্ধি দেশীয় আমদানি খাত এবং সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয়ে সরাসরি প্রভাব ফেলছে। এই অস্থিরতার মধ্যেই সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংক যৌথভাবে একাধিক কৌশল বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েছে, যার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ডলারের বিনিময় হারের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। কঠোর নজরদারি এবং নিয়মিত তদারকির মাধ্যমে কালোবাজারি ও অবৈধ লেনদেন দমন করার লক্ষ্যে সরকার সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর মনিটরিং ব্যবস্থা
বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যেই দেশের সকল বাণিজ্যিক ব্যাংকের ফরেক্স ডিলিং কার্যক্রমের উপর কঠোর নজরদারি শুরু করেছে। প্রতিটি ব্যাংককে প্রতিদিনের লেনদেন, স্প্রেড (ক্রয় ও বিক্রয় মূল্যের ব্যবধান) এবং বিনিময় হারের তথ্য নিয়মিতভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা দিতে হচ্ছে। এর পাশাপাশি, যেসব ব্যাংক অতিরিক্ত হারে ডলার বিক্রি করছে বা বাজারে কৃত্রিম চাপ তৈরি করছে, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এতে ব্যাংকগুলো এখন আরও সতর্কভাবে ডলার লেনদেনে অংশ নিচ্ছে এবং বাজারে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করছে।
বৈধ হুন্ডি ও রেমিট্যান্স প্রবাহের উপর গুরুত্ব
দেশে বৈধ রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার কয়েকটি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো প্রবাসীদের জন্য ২.৫% নগদ প্রণোদনা, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দ্রুত টাকা হস্তান্তরের সুবিধা এবং বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোর সঙ্গে সমন্বিত কার্যক্রম। হুন্ডি বা অবৈধ পথে অর্থ পাঠানোকে নিরুৎসাহিত করতে প্রশাসনিক অভিযানও বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে প্রবাসী আয় এখন আবার বাড়তে শুরু করেছে, যা ডলারের বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
আমদানি নিয়ন্ত্রণে কড়াকড়ি
অপ্রয়োজনীয় এবং বিলাসবহুল পণ্যের আমদানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ডলারের ওপর চাপ কমাতে সরকার সচেষ্ট। বাংলাদেশ ব্যাংক এলসি খোলার ক্ষেত্রে নতুন নীতিমালা চালু করেছে, যেখানে অগ্রাধিকারভিত্তিক পণ্য ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে কঠোর শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। যেমন—ব্যাংকগুলোর নিজস্ব বৈদেশিক মুদ্রার সংস্থান না থাকলে এলসি অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে না। ফলে বিলাসপণ্য আমদানি হ্রাস পেয়েছে এবং ডলারের চাহিদাও অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা কমেছে।

ছবিঃ ফিনান্সিল এক্সপেরিয়েন্স
বৈদেশিক বাণিজ্যে স্বচ্ছতা নিশ্চিতের পদক্ষেপ
বাণিজ্যের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যৌথভাবে কাজ করছে। আমদানির বিপরীতে মিথ্যা ইনভয়েস, অতিরিক্ত ডলারের দাবি এবং কাগজপত্রে ভিন্নতা যাচাই করার জন্য নতুন সফটওয়্যার চালু করা হয়েছে। এ ছাড়া অর্থ পাচার এবং অবৈধ লেনদেন চিহ্নিত করতে ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (FIU) আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে ডলার ভিত্তিক লেনদেন স্বচ্ছ ও সুনিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।
বিদেশ ভ্রমণে ডলার বরাদ্দ সীমিতকরণ
একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবে সরকার ব্যক্তিগত বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে ডলার বরাদ্দ সীমিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগে যেখানে প্রতি ব্যক্তি বছরে ১২ হাজার মার্কিন ডলার পর্যন্ত কিনতে পারতেন, এখন তা কমিয়ে ৫ হাজার ডলারে নামিয়ে আনা হয়েছে। এ ছাড়া ব্যবসায়িক সফরের ক্ষেত্রেও প্রয়োজনীয়তা যাচাই করে ডলার বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে অপ্রয়োজনীয় বৈদেশিক ব্যয় রোধ হচ্ছে এবং দেশে ডলার ধরে রাখার প্রবণতা বাড়ছে।
রপ্তানি আয়ের দ্রুত প্রত্যাবাসন নিশ্চিতকরণ
বাংলাদেশ ব্যাংক রপ্তানিকারকদের আয় নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই দেশে নিয়ে আসতে বাধ্য করছে। কেউ যদি অনিয়ম করে বিলম্ব করে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে জরিমানা ও লাইসেন্স বাতিলের মতো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি, রপ্তানি আয় দেশে নিয়ে আসা সহজ করতে ব্যাংকগুলোকে বিভিন্ন প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। এতে করে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কিছুটা হলেও বাড়ানো সম্ভব হয়েছে।
বাজারে জনসচেতনতা ও গণমাধ্যমের ভূমিকা
ডলার বাজার নিয়ন্ত্রণে গণমাধ্যম ও সাধারণ জনগণের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। ভুল তথ্য বা গুজব ছড়িয়ে বাজারে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা প্রতিরোধে সরকার গণমাধ্যমকে পাশে চাইছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও তথ্য মন্ত্রণালয় যৌথভাবে প্রচারণা চালাচ্ছে, যাতে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত না হয় এবং অনৈতিকভাবে ডলার ক্রয়ে উদ্বুদ্ধ না হয়। এই সচেতনতামূলক কার্যক্রম বাজারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।