আশুলিয়ায় মধ্যরাতে হামলা, আহত ৮ এনসিপি ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতা

এনসিপি নেতা আহত,

আশুলিয়ায় মধ্যরাতে সংঘটিত এক রহস্যময় হামলায় গুরুতর আহত হন ৮ জন এনসিপি ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতা। স্থানীয়রা হামলাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করছেন। তদন্তের দাবি জোরালো হচ্ছে। ছবিঃ প্রথম আলো

হঠাৎ করেই আশুলিয়ার নিরব রাত ভেঙে দেয়া হলো সন্ত্রাসী হামলার চিৎকারে

ঢাকার আশুলিয়ার জামগড়া এলাকাটি সাধারণত শান্তিপূর্ণ একটি শ্রমিক অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। কিন্তু গতকাল রাত প্রায় ১টার দিকে হঠাৎ করেই এলাকাটি রূপ নেয় আতঙ্কের জনপদে। এনসিপি ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের একাধিক নেতাকর্মী একটি ঘরোয়া সভা শেষে বের হওয়ার সময়ই তাদের ওপর হামলা চালানো হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হামলাকারীরা সংখ্যায় ছিল অন্তত ১০ থেকে ১২ জন এবং তাদের বেশিরভাগের মুখ কাপড়ে ঢাকা ছিল। তারা লাঠি, রড, লোহার পাইপ এবং ধারালো অস্ত্র নিয়ে খুব দ্রুততার সাথে আক্রমণ চালিয়ে পালিয়ে যায়। এমন আচমকা আক্রমণে পুরো এলাকাজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

আহতদের রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার, অধিকাংশের অবস্থা আশঙ্কাজনক

হামলার পরপরই স্থানীয়রা এগিয়ে এসে আহতদের উদ্ধার করে প্রথমে আশুলিয়া থানা হাসপাতাল ও পরে সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেন। সেখানে চিকিৎসা সেবা না পেয়ে পাঁচজনকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। আহতদের শরীরে গভীর জখম, মাথায় মারাত্মক আঘাত ও পিঠে ধারালো অস্ত্রের ক্ষত পাওয়া গেছে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। একজন আহতের রক্তক্ষরণ এতটাই বেশি ছিল যে চিকিৎসকদের মতে, কয়েক মিনিট দেরি হলে প্রাণহানি ঘটতে পারত। আহতদের পরিবারের সদস্যরা জানান, তাদের প্রিয়জনরা দীর্ঘদিন ধরে বৈষম্য ও সামাজিক ন্যায়বিচারের পক্ষে কাজ করছিলেন।

রাজনৈতিক প্রতিহিংসা না কি পূর্বপরিকল্পিত অপারেশন?

এই হামলা কেবল একটি সন্ত্রাসী তাণ্ডব নয়, বরং এর পেছনে একটি সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল বলে মনে করছেন আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ। তারা জানান, সম্প্রতি আশুলিয়ায় অনুষ্ঠিত একটি গণসমাবেশে এনসিপি ও তাদের মিত্র সংগঠনগুলো দেশের বিদ্যমান শ্রেণিবৈষম্য, শ্রমিক অধিকারের সংকট এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অবস্থা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করে। এই খোলামেলা বক্তব্যই একশ্রেণির সুবিধাভোগীদের ক্ষুব্ধ করেছে বলে তারা মনে করছেন। এছাড়াও, সভার কিছু ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর থেকেই তারা নানা হুমকি-ধামকির মুখে পড়ছিলেন।

প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা ও স্থানীয়দের ক্ষোভ

ঘটনার পর পুলিশ ঘটনাস্থলে এলেও এখনো পর্যন্ত কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, এমন একটি বড় আকারের সংঘবদ্ধ হামলার আগে কোনো গোয়েন্দা তথ্য না থাকা এবং হামলাকারীদের সহজেই পালিয়ে যাওয়া প্রশাসনের দায়িত্বে গাফিলতির ইঙ্গিত দেয়। এলাকাবাসী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এর আগেও আশুলিয়ায় ছোটখাটো রাজনৈতিক সংঘর্ষ হয়েছে, কিন্তু এমন পরিকল্পিত হামলা আগে কখনো দেখেনি। তারা আশঙ্কা করছেন, যদি দোষীদের আইনের আওতায় আনা না হয় তবে ভবিষ্যতে আরও বড় ধরনের সহিংসতা ঘটতে পারে।

এনসিপির প্রতিবাদ ও দেশব্যাপী বিক্ষোভের ডাক

ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে এনসিপির কেন্দ্রীয় কমিটি এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “এটি কেবল আমাদের নেতা-কর্মীদের ওপর নয়, সমগ্র গণতান্ত্রিক কাঠামোর ওপর আঘাত।” তারা দেশব্যাপী প্রতিবাদ সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে এবং সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যেন নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হয়। পাশাপাশি তারা আহতদের চিকিৎসার খরচ বহনের জন্য বিশেষ তহবিল গঠনের ঘোষণা দিয়েছে।

এই হামলার ঘটনায় বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ‘অধিকার’, ‘বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফোরাম’, ‘এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন’সহ একাধিক সংগঠন বলেছে, “এটি মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর একটি সরাসরি আঘাত এবং রাষ্ট্রের ব্যর্থতা প্রকাশ করে।” তারা এই হামলার ন্যায়বিচারের পাশাপাশি রাজনৈতিক মতপ্রকাশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে।

সামাজিক মাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড়

এই ঘটনার পরপরই সামাজিক মাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। অনেকেই আহতদের ছবি ও ভিডিও শেয়ার করে হামলার নিন্দা জানাচ্ছেন এবং প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন। হ্যাশট্যাগ #JusticeForAshuliaVictims, #StopPoliticalViolence ট্রেন্ডিং হয়ে ওঠে টুইটার ও ফেসবুকে। সাধারণ নাগরিকরা সরকারের প্রতি দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছেন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষপাতমূলক আচরণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন।

হামলার পর এনসিপি ও সংশ্লিষ্ট আন্দোলনের অনেক নেতাকর্মী এখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তারা অভিযোগ করছেন, হামলার পর পুলিশ বা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখনো তাদের সাথে যোগাযোগ করা হয়নি কিংবা কোনোরকম নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়নি। একাধিক নেতা ইতিমধ্যে স্থানীয় এলাকা ছেড়ে আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হয়েছেন। এনসিপির এক নেতা বলেন, “আমরা রাজপথে দাঁড়িয়ে বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলি, কিন্তু এখন নিজেরাই নিরাপদ নই।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *