অর্থ উপদেষ্টার মন্তব্য: বাজেট ‘আংশিকভাবে প্রচলিত’ হলেও স্থিতিশীল

বাজেট বিশ্লেষণ

২০২৫-২৬ বাজেটকে ‘আংশিকভাবে প্রচলিত’ আখ্যা দিয়ে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, এতে স্থিতিশীলতা বজায় থাকলেও উদ্ভাবনী পদক্ষেপের ঘাটতি রয়েছে। জানুন বাজেট বিশ্লেষণের বিস্তারিত। ছবিঃ প্রথম আলো

বাজেট মূল্যায়ন: ‘আংশিকভাবে প্রচলিত’ ব্যাখ্যায় কী বুঝালেন অর্থ উপদেষ্টা

২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণা করার পর থেকেই অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা নানা মতামত প্রকাশ করছেন। এদের মধ্যে অন্যতম অর্থ উপদেষ্টা বাজেটটিকে ‘somewhat conventional’ বা ‘আংশিকভাবে প্রচলিত’ আখ্যা দিয়েছেন। তার মতে, বাজেটের কাঠামোতে এমন কোনো দৃষ্টান্তমূলক বা সংস্কারধর্মী পদক্ষেপ দেখা যায়নি যা আগের বাজেটগুলোর থেকে ভিন্ন। বরং সরকার একধরনের ভারসাম্য বজায় রেখে চলার চেষ্টা করেছে, যেখানে খরচ ও রাজস্ব উভয় ক্ষেত্রেই একটি সতর্ক নীতির প্রতিফলন রয়েছে। তিনি মনে করেন, সময়ের প্রেক্ষিতে বাজেটে কিছু সাহসী সিদ্ধান্ত প্রয়োজন ছিল, যা অনুপস্থিত।

উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টায় রক্ষণশীল পন্থা

অর্থ উপদেষ্টার বিশ্লেষণ অনুযায়ী, বাজেটটি সরকারকে চলমান উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখতে সহায়তা করবে, তবে এটি একটি রক্ষণশীল অর্থনৈতিক কৌশল অনুসরণ করেছে। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস এবং বৈশ্বিক বাজারে অনিশ্চয়তা থাকায় সরকার বড় ধরনের আর্থিক ঝুঁকি নিতে চায়নি। বাজেটের মধ্যে বেশ কিছু খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হলেও তা পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করা হচ্ছে। যেমন, ভর্তুকি কমানো, ব্যয় নিয়ন্ত্রণ, এবং কর নীতিতে খুব বেশি পরিবর্তন না আনা—এই সিদ্ধান্তগুলো মূলত অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রতি সরকারের অঙ্গীকার নির্দেশ করে।

রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা উচ্চাভিলাষী, তবে বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন

নতুন বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ৫ লক্ষ কোটি টাকার কাছাকাছি নির্ধারণ করা হয়েছে, যা পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। তবে অর্থ উপদেষ্টা মনে করেন, বিদ্যমান কর কাঠামো ও প্রশাসনিক দুর্বলতা এই উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। বিগত বছরগুলোতে এনবিআর একাধিকবার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে, যার ফলে রাজস্ব ঘাটতি বেড়েছে। করজাল বাড়ানো এবং কর ফাঁকি প্রতিরোধে যথাযথ প্রযুক্তি ও নীতিমালা না থাকলে বাজেট বাস্তবায়ন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে বলে তিনি সতর্ক করেন।

সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি: একটি ইতিবাচক দিক

বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বরাদ্দ প্রায় ১ লক্ষ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়েছে, যা দেশের দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগণের জন্য স্বস্তির বিষয়। অর্থ উপদেষ্টা বলেন, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা এবং শিক্ষাবৃত্তি কর্মসূচিতে বাড়তি অর্থ বরাদ্দ সঠিক পথে গেলে তা অর্থনৈতিক বৈষম্য কমাতে সহায়ক হবে। বিশেষ করে, গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে জীবনমান উন্নয়নের জন্য এই ধরনের সহায়তা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। তবে তিনি এই খাতে দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধে ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা চালুর ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

 অর্থ উপদেষ্টার মন্তব্য

ছবিঃ প্রথম আলো

শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে অপ্রতুল বরাদ্দে উন্নয়ন বিঘ্নিত হওয়ার শঙ্কা

অর্থ উপদেষ্টার মতে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতকে উন্নয়নের মূল চালিকা শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হলেও বাজেটে এই দুই খাতে বরাদ্দ এখনও প্রত্যাশিত মানে পৌঁছায়নি। শিক্ষা খাতে নতুন প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা, শিক্ষক নিয়োগ, ও পাঠ্যপুস্তক উন্নয়নে আরও বরাদ্দ প্রয়োজন। স্বাস্থ্য খাতে হাসপাতালে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, ওষুধ সরবরাহ এবং চিকিৎসা সেবার বিস্তারের জন্য যে পরিমাণ অর্থ দরকার, তা এখনও ঘাটতি রয়েছে। তিনি বলেন, মানবসম্পদ উন্নয়নে বিনিয়োগ না বাড়ালে টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন কঠিন হয়ে পড়বে।

বিনিয়োগ ও শিল্পায়নকে উৎসাহিত করার জন্য প্রণোদনার ঘাটতি

দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম প্রধান ভিত্তি হলো বিনিয়োগ ও শিল্পায়ন, যেখানে বাজেটে উল্লেখযোগ্য প্রণোদনার অভাব দেখা গেছে। অর্থ উপদেষ্টা বলেন, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, শিল্প পার্ক, এবং এসএমই উদ্যোক্তাদের জন্য কর ছাড় ও সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা নিশ্চিত না করলে কর্মসংস্থান বাড়বে না। এছাড়া বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে নীতিগত স্থিতিশীলতা ও প্রশাসনিক জটিলতা কমানো জরুরি। তিনি বলেন, বাজেটে যদি এই খাতে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও সুযোগ রাখা হতো, তাহলে অর্থনীতির গতি আরও বেগবান হতো।

বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে এক ধরনের রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যেখানে ব্যাংকিং খাত, রপ্তানি খাত, এবং দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অর্থ উপদেষ্টা বলেন, বাজেটে কাঠামোগত সংস্কারের কোনো দৃশ্যমান পরিকল্পনা না থাকায় ভবিষ্যতে জটিলতা বাড়তে পারে। ব্যাংকিং খাতে ঋণ খেলাপির সংখ্যা বাড়ছে, যা নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় আইনগত সংস্কার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর ভূমিকা দেখা যায়নি। একইভাবে, কর ব্যবস্থায় ডিজিটাল রূপান্তর ছাড়া স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যাবে না।

স্থিতিশীল কিন্তু সংস্কারহীন বাজেট

সবকিছু বিবেচনায় অর্থ উপদেষ্টা বলেন, বাজেটটি স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সক্ষম হলেও এটি মৌলিক বা রূপান্তরমূলক বাজেট নয়। সরকার একটি মধ্যপন্থা গ্রহণ করেছে, যা একদিকে রাজস্ব আদায় ও ব্যয়ের ভারসাম্য বজায় রাখে, অন্যদিকে নতুন অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেই। জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী বাজেট আরও কর্মসংস্থানমুখী, উদ্ভাবনী ও সমন্বিত হতে পারত। তিনি বলেন, বাজেট যেন বাস্তবায়নেই আটকে না থাকে, এজন্য বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সময়মত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *