সাকরাইন ২০২৫: ঐতিহ্য, উল্লাস আর পুরান ঢাকার প্রাণের উৎসব

পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সাকরাইন উৎসব এবারো ঘুড়ি উড়ানো, আতশবাজি, পিঠা-পুলি আর সাংস্কৃতিক আনন্দে উদযাপিত হয়েছে। শহরের আকাশজুড়ে ছিল হাজার রঙের ঘুড়ির ঝলক। ছবি: ভ্রমণ গেইট
সাকরাইন উৎসব: ঐতিহ্যের রঙিন ছোঁয়া
সাকরাইন, যাকে পৌষ সংক্রান্তি নামেও ডাকা হয়, এটি পুরান ঢাকার প্রাণের উৎসব। বহু প্রাচীন এই উৎসব প্রতি বছর পৌষ মাসের শেষ দিনে উদযাপিত হয়, এবং ঢাকার পুরানো এলাকাগুলো এই দিনে রূপ নেয় এক রঙিন উৎসবস্থলে। দিনের শুরু থেকেই ছাদে ছাদে ঘুড়ি উড়ানো শুরু হয় এবং রাত পর্যন্ত চলে উৎসবের আনন্দ। একসময় শুধুই ধর্মীয় বা কৃষিভিত্তিক উৎসব হলেও এখন এটি শহরের প্রাণবন্ত সংস্কৃতির প্রতীক হয়ে উঠেছে। এই উৎসব পুরান ঢাকার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সামাজিক সংহতির অনন্য নিদর্শন।
সাকরাইন, যা পৌষ সংক্রান্তি নামেও পরিচিত, পুরান ঢাকার অন্যতম ঐতিহ্যবাহী উৎসব। প্রতি বছর জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে এই উৎসব পালিত হয়, যা মূলত ঘুড়ি উড়ানো, আতশবাজি, পিঠা-পুলি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উদযাপিত হয়। পুরান ঢাকার শাঁখারী বাজার, সূত্রাপুর, গেন্ডারিয়া, সদরঘাট, ধোলাইখাল, ইসলামপুর, হাজারীবাগ, নবাবপুর ও তাঁতিবাজার এলাকায় এই উৎসবের আমেজ সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। News Bangla 24+1বিশ্ব প্রান্তরে+1
ঘুড়ির যুদ্ধ: আকাশজুড়ে রঙের খেলা
সকালে সূর্য উঠার আগেই ঘুড়ি প্রেমীরা নিজেদের ছাদে অবস্থান নেন। রঙিন ঘুড়ি আর ধারালো মানজা (ঘুড়ির সুতা) নিয়ে চলে ‘ঘুড়ির যুদ্ধ’। ঘুড়ি কাটাকাটি যেন এই উৎসবের প্রাণ। বিভিন্ন আকৃতির ঘুড়ি যেমন মাসদার, গরুদান, কয়রা কিংবা চারভুজা ঘুড়ি উড়ে আকাশে। প্রতিবেশীরা প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে, কার ঘুড়ি কতক্ষণ থাকে আকাশে—তা নিয়ে চলে উচ্ছ্বাস ও চিৎকার। এই প্রতিযোগিতার মাঝে জন্ম নেয় একধরনের বন্ধুত্ব ও আনন্দ, যা সাকরাইনকে শুধু একটি উৎসব নয়, বরং একটি সামাজিক মিলনমেলা হিসেবে গড়ে তোলে।
সকালের প্রথম প্রহর থেকেই পুরান ঢাকার আকাশ রঙিন ঘুড়িতে ভরে যায়। বিভিন্ন আকৃতি ও রঙের ঘুড়ি যেমন— পানদার, মাসদার, গরুদান, কয়ড়া, লেজ লম্বা, চারভুয়াদার, গায়েল ইত্যাদি ঘুড়ি উড়ানো হয়। ঘুড়ি উড়ানোর পাশাপাশি চলে ঘুড়ি কাটাকাটির প্রতিযোগিতা, যেখানে অংশগ্রহণকারীরা একে অপরের ঘুড়ি কাটার চেষ্টা করেন। বিশ্ব প্রান্তরে+1News Bangla 24+1News Bangla 24
সন্ধ্যার পরে আতশবাজি আর আগুনের খেলা
দিনের ঘুড়ি যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর সন্ধ্যার সাথে সাথে ছাদগুলো রূপ নেয় একেকটি আলোর মঞ্চে। ছেলেমেয়েরা হাতে ফানুস উড়িয়ে আকাশে আলো জ্বালায়, আর ছাদ থেকে ছাদে বেজে ওঠে আতশবাজির বিস্ফোরণ। সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো ‘আগুন নিয়ে খেলা’, যেখানে তরুণরা মুখে কেরোসিন নিয়ে আগুন নিঃসরণ করে তৈরি করে নাটকীয় আগুনের শো। লেজার লাইট, ডিজে পার্টি, ড্রাম বাজিয়ে ছাদে ছাদে নাচগান—সব মিলিয়ে পুরান ঢাকা যেন এক রঙিন বর্ণিল মহোৎসবে পরিণত হয়। এই রাতের স্মৃতি বছরজুড়ে মনে গেঁথে থাকে পুরান ঢাকাবাসীর।
সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে শুরু হয় আতশবাজি ও ফানুস উড়ানোর অনুষ্ঠান। পুরান ঢাকার আকাশ রঙিন আলোয় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তরুণরা মুখে কেরোসিন নিয়ে আগুনের খেলা প্রদর্শন করেন, যা দর্শকদের মুগ্ধ করে। বাড়ির ছাদে ছাদে ডিজে পার্টি ও নাচ-গানের আয়োজন হয়, যা উৎসবের আনন্দকে বহুগুণে বাড়িয়ে তোলে।

ছবি: সময় টিভি
পিঠা-পুলি ও ঐতিহ্যবাহী খাবার
সাকরাইন উৎসবের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো পিঠা-পুলি ও ঐতিহ্যবাহী খাবার। বাড়িতে বাড়িতে তৈরি হয় বিভিন্ন ধরনের পিঠা, যেমন— চিতই, ভাপা, পাটিসাপটা ইত্যাদি। এছাড়াও পরিবেশন করা হয় খিচুড়ি, কাচ্চি বিরিয়ানি, বাকরখানি ও মিষ্টান্ন। এই খাবারগুলো আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের মাঝে ভাগ করে খাওয়া হয়, যা সামাজিক বন্ধনকে আরও মজবুত করে।
ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সমন্বয়
সাকরাইন উৎসবের মাধ্যমে পুরান ঢাকার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সংরক্ষিত হচ্ছে। তবে আধুনিকতার ছোঁয়ায় উৎসবে যোগ হয়েছে ডিজে পার্টি, লেজার লাইট শো ও অন্যান্য আধুনিক বিনোদন। এই সমন্বয় পুরান ঢাকার তরুণ প্রজন্মকে উৎসবের প্রতি আকৃষ্ট করছে এবং ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিকে জীবন্ত রাখছে।
সাকরাইন শুধু একটি ব্যক্তিগত বা পারিবারিক আনন্দের বিষয় নয়, এটি একটি সম্প্রদায়ভিত্তিক উৎসব। এখানে সবাই অংশ নেয়—ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে। একই ছাদে দেখা যায় মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান এবং বৌদ্ধদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে। শিশুরা, বয়স্করা, তরুণ-তরুণীরা সবাই একত্রিত হন এক আনন্দের পরিসরে। প্রতিবেশী পরিবারগুলো একে অপরকে আমন্ত্রণ জানায় ছাদে যাওয়ার জন্য। অনেক এলাকায় স্থানীয় যুবকরা ছোট ছোট সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করে, গান-বাজনা আর কবিতা আবৃত্তির মাধ্যমে আরও উজ্জ্বল করে এই দিনটিকে।
স্মৃতিতে রয়ে যায় সাকরাইনের আলো ও রং
সাকরাইন উৎসব শেষ হয়ে যায় এক রাতের মধ্যে, কিন্তু তার রেশ থাকে অনেকদিন। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউবজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ঘুড়ি যুদ্ধ, ফানুস ও আগুনের খেলার ভিডিও। পুরান ঢাকার মানুষজন এই দিনটিকে স্মরণ করে বিশেষ ভালোবাসায়। যারা ঢাকার বাইরে থাকেন, তারাও এই দিনটিকে মিস করেন হৃদয়ের গভীরে। বছরের পর বছর ধরে সাকরাইন তাদের শিকড়ের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। এটি শুধু একটি উৎসব নয়, এটি পুরান ঢাকার একটি জীবন্ত চিত্র, যেখানে ঐতিহ্য, ভালোবাসা ও আনন্দ একত্রিত হয়ে উঠে।
সাকরাইন উৎসব পুরান ঢাকার সামাজিক সংহতি ও সম্প্রদায়ের বন্ধনকে আরও দৃঢ় করে। এই উৎসবে ধর্ম, বয়স ও পেশা নির্বিশেষে সবাই অংশগ্রহণ করেন। এটি একটি পারিবারিক ও সামাজিক মিলনমেলা, যেখানে সবাই একত্রিত হয়ে আনন্দ উপভোগ করেন। এই উৎসবের মাধ্যমে পুরান ঢাকার মানুষদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক আরও মজবুত হয়। বিশ্ব প্রান্তরে+1News Bangla 24+1