আসন্ন অর্থবছর ২০২৫-২৬ এ সম্ভাব্য কর ও শুল্ক ব্যবস্থাপনা

বাজেট আপডেট বাংলাদেশ

২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে কর ও শুল্ক ব্যবস্থা কীভাবে পরিবর্তন হতে পারে এবং তা দেশের অর্থনীতি, ব্যবসা ও সাধারণ নাগরিকদের ওপর কী প্রভাব ফেলবে, জানুন বিস্তারিতভাবে এই প্রতিবেদনে। ছবিঃ সালমান সাকিব শাহরিয়ার

বাজেট প্রক্রিয়ার পটভূমি ও রাজস্ব চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশ সরকার ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করেছে এমন একটি সময়ে, যখন বৈশ্বিক অর্থনীতি সংকটাপন্ন এবং অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পৌঁছাতে পারছে না। চলতি অর্থবছরের তুলনায় FY26 বাজেট হবে আরও বাস্তবভিত্তিক ও রাজস্ব-নির্ভর। বৈদেশিক সহায়তা কমে যাওয়া, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ এবং ব্যাংকিং খাতের নাজুক অবস্থা মাথায় রেখে অর্থ মন্ত্রণালয় এমন এক কর ও শুল্ক কাঠামো চূড়ান্ত করতে চায়, যা একদিকে রাজস্ব বাড়াবে, অন্যদিকে বিনিয়োগ ও ভোক্তাদের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে না। এনবিআরসহ সংশ্লিষ্ট সব সংস্থা এবারের বাজেটে সমন্বিত রাজস্ব কৌশলের জন্য কাজ করছে।

ব্যক্তিগত আয়কর কাঠামোতে সম্ভাব্য নতুন চিন্তাভাবনা

নতুন অর্থবছরে কর ও শুল্ক ব্যবস্থা FY26 অনুযায়ী ব্যক্তিগত আয়কর কাঠামোতে পরিবর্তন আনার চিন্তা চলছে। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির ওপর করের চাপ কমানোর জন্য করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে যেখানে করমুক্ত সীমা ৩ লাখ টাকা, তা ৩.৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত করার আলোচনা রয়েছে। তবে উচ্চ আয়ের করদাতাদের জন্য করহার বাড়ানোর প্রস্তাবও আসছে, যার ফলে রাজস্ব আহরণ বাড়ানো সম্ভব হবে। সরকার কর ফাঁকি বন্ধে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার, ডিজিটাল রিটার্ন জমা ও ই-টিআইএন ব্যবস্থাকে বাধ্যতামূলক করতে চাচ্ছে।

মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ব্যবস্থায় ডিজিটাল রূপান্তর

কর ও শুল্ক ব্যবস্থা FY26-এ ভ্যাট ক্ষেত্রেও বড় ধরনের রূপান্তর আসতে পারে। বর্তমান ব্যবস্থায় হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও রিটেইল চেইনে ভ্যাট ফাঁকি ব্যাপক। এই খাতগুলোতে বাধ্যতামূলক ই-ইনভয়েসিং ও ই-রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে ভ্যাট সংগ্রহ নিশ্চিত করার পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের কর সুবিধা দিতে একটি নির্ধারিত হারে ভ্যাট আরোপ করা হতে পারে, যাতে তারা সহজে রিটার্ন জমা দিতে পারেন এবং প্রশাসনিক জটিলতা এড়ানো যায়। একইসঙ্গে ই-ভ্যাট চালান ব্যবস্থায় স্বয়ংক্রিয়তা আনার পরিকল্পনাও রয়েছে।

আমদানি শুল্ক কাঠামোয় নতুন অগ্রাধিকার

বাংলাদেশের আমদানি নির্ভরতাকে ভারসাম্যপূর্ণ করতে এবং ডলার সংকট মোকাবেলায় কর ও শুল্ক ব্যবস্থা FY26-এ আমদানি শুল্ক কাঠামোতে পুনর্বিন্যাসের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। বিলাসবহুল ও অপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়ানোর মাধ্যমে স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা দিতে চায় সরকার। বিদেশি গাড়ি, মোবাইল ফোন, কসমেটিকস ও আমদানি করা খাদ্যপণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের চিন্তা চলছে। অন্যদিকে কৃষি যন্ত্রপাতি, শিল্প কাঁচামাল, ও প্রযুক্তি পণ্যের ওপর শুল্ক ছাড় ও ছাড়কৃত হারে শুল্ক ধার্য রাখার সম্ভাবনা রয়েছে, যাতে উৎপাদন খরচ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।

কর ব্যবস্থা FY26

ছবিঃ ঢাকা ট্রিবিউন

শিল্প ও রপ্তানি খাতের কর ছাড় অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা

স্থানীয় শিল্প ও রপ্তানি খাতকে আরো চাঙ্গা রাখতে কর ও শুল্ক ব্যবস্থা FY26 অনুসারে বেশ কয়েকটি খাতে কর ছাড় অব্যাহত থাকতে পারে। বিশেষত তৈরি পোশাক খাত, তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প, ওষুধ শিল্প এবং চামড়া শিল্পের জন্য প্রণোদনা বজায় রাখা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। স্টার্টআপ এবং উদ্যোক্তা পর্যায়ে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও কর ছাড় সুবিধা পেতে পারে। এই নীতির মাধ্যমে শিল্প খাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং দেশের সার্বিক উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

সবুজ অর্থনীতিকে উৎসাহিত করতে কর প্রণোদনা

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে কর ও শুল্ক ব্যবস্থা FY26-এ পরিবেশবান্ধব উদ্যোগকে উৎসাহিত করতে আলাদা গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি (সোলার, বায়ু), ইলেকট্রিক যানবাহন (EV), গ্রিন বিল্ডিংস এবং পরিবেশবান্ধব পণ্য উৎপাদনে নিয়োজিত উদ্যোক্তাদের জন্য কর ছাড় ও শুল্ক রেয়াতের ব্যবস্থা করা হতে পারে। এতে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ও ক্লাইমেট ফান্ডিং উৎসগুলো থেকে অতিরিক্ত সহায়তা পাওয়া সম্ভব হবে। সরকার এই ধরণের পরিকল্পনার মাধ্যমে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে একধাপ এগিয়ে যেতে চায়।

রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ও কর আদায়ের কৌশল

২০২৫-২৬ অর্থবছরে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা আগের বছরের তুলনায় অন্তত ১৫ শতাংশ বাড়ানো হবে বলে জানানো হয়েছে। এনবিআর করজাল সম্প্রসারণে জাতীয় পরিচয়পত্র, মোবাইল ব্যাংকিং ও সম্পত্তি নিবন্ধন তথ্যের মাধ্যমে সম্ভাব্য করদাতা শনাক্তে ডিজিটাল বিশ্লেষণ পদ্ধতি ব্যবহার করতে চাচ্ছে। অপ্রদর্শিত আয়ের ওপর নির্দিষ্ট শর্তে কর দিয়ে বৈধ করার সুযোগ সীমিত করা হতে পারে। পাশাপাশি রাজস্ব বিভাগের কর্মক্ষমতা মূল্যায়ন ও পুরস্কারভিত্তিক প্রণোদনা চালুর মাধ্যমে কর সংগ্রহ কার্যক্রম আরও গতিশীল করার পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *