গাজায় খাদ্যকে ‘যুদ্ধাস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করছে ইসরায়েল

গাজা খাদ্য সংকট

ইসরায়েল গাজায় খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে এটিকে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার প্রধান ফিলিপ লাজারিনির। পড়ুন বিস্তারিত রিপোর্ট। ছবিঃ বিবিসি

ইসরায়েলের খাদ্য অবরোধ গাজায় ‘যুদ্ধাস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে: বিবিসিকে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার প্রধান

গাজা, ১৩ মে ২০২৫
গাজায় মানবিক সংকট নিয়ে জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থা (UNRWA)-এর প্রধান ফিলিপ লাজারিনি একটি বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, ইসরায়েল গাজায় খাদ্য সরবরাহ ইচ্ছাকৃতভাবে বন্ধ করে দিয়ে এটিকে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “ক্ষুধা এখন একটি অস্ত্র—এটি শুধু মানবিক সংকট নয়, বরং একটি কৌশলগত চাপ প্রয়োগের হাতিয়ার।”

পরিকল্পিতভাবে খাদ্য সরবরাহ বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে

ফিলিপ লাজারিনি অভিযোগ করেন, গাজায় খাদ্য, পানি, ওষুধসহ জরুরি ত্রাণ সরবরাহের পথে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ বারবার বাধা সৃষ্টি করছে। তিনি বলেন, “আমরা প্রতিদিন খাদ্যবাহী ট্রাক রাফা সীমান্তে আটকে যেতে দেখছি। এগুলো ঢুকতে না পারার কারণে লাখ লাখ মানুষ অনাহারে ভুগছে।”

তিনি জানান, জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকে প্রতিনিয়ত সহযোগিতা চাওয়া হলেও ইসরায়েল তাতে কার্যকর সাড়া দিচ্ছে না। অনেক সময় খাদ্য সামগ্রী অনুমতি ছাড়াই ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে বা তল্লাশির নামে বিলম্ব ঘটানো হচ্ছে, যার ফলে খাবার নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

গাজায় অনাহারের ভয়াবহ চিত্র

জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, গাজায় বর্তমানে প্রায় ২.৩ মিলিয়ন মানুষ চরম খাদ্য ঘাটতির সম্মুখীন। শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি মারাত্মক হারে বেড়েছে। অনেক পরিবার দিনে মাত্র একটি বা দুইটি খাবার গ্রহণ করতে পারছে, তাও অপ্রতুল এবং পুষ্টিহীন।

UNRWA প্রধান বলেন, “অনাহারকে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধের শামিল। এটি শুধুমাত্র মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়, বরং জাতিসংঘ সনদেরও পরিপন্থী।”

ইসরায়েলি অবস্থান ও প্রতিক্রিয়া

ইসরায়েলের পক্ষ থেকে যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে এই অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে, তথাপি একাধিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এই সংকটের জন্য ইসরায়েলকেই দায়ী করছে। ইসরায়েল দাবি করছে, নিরাপত্তার কারণে তারা সব ধরনের ত্রাণ সামগ্রী পর্যবেক্ষণ করে সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করতে দিচ্ছে।

তবে বাস্তব চিত্র ভিন্ন। গাজায় খাদ্যের স্বাভাবিক প্রবাহ বিঘ্নিত হওয়ায় স্থানীয় বাজারগুলোতেও দাম আকাশছোঁয়া হয়ে উঠেছে। সাধারণ জনগণ নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী কিনতে পারছে না।

ইসরায়েল গাজা যুদ্ধ

ছবিঃ বিবিসি

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও উদ্বেগ

জাতিসংঘ, রেড ক্রস, ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক মানবিক সংস্থা গাজায় চলমান খাদ্য সংকটকে “মানবিক বিপর্যয়” বলে আখ্যা দিয়েছে। তারা ইসরায়েলকে অনতিবিলম্বে সব ধরনের মানবিক সহায়তা প্রবেশের অনুমতি দিতে আহ্বান জানিয়েছে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানবাধিকার কর্মী ও সাধারণ মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ায় ইসরায়েলের এই অবরোধের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করছে। ‘Starving Gaza is a war crime’—এই স্লোগানটি এখন একটি বৈশ্বিক প্রতিবাদের রূপ নিয়েছে।

যুদ্ধাপরাধের প্রসঙ্গ ও সম্ভাব্য আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইচ্ছাকৃতভাবে খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে একটি জনসংখ্যাকে দুর্ভিক্ষের মুখে ঠেলে দেওয়া স্পষ্টতই যুদ্ধাপরাধের আওতায় পড়ে। তারা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (ICC) মাধ্যমে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

এছাড়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আফ্রিকান ইউনিয়ন ও আরব লীগ গাজায় অবিলম্বে খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে জোরালো রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করছে। এই চাপ কতটা কার্যকর হবে, তা এখনও অনিশ্চিত।

মানবতার প্রশ্ন ও নৈতিক চ্যালেঞ্জ

এই সংকট শুধু রাজনৈতিক বা কৌশলগত নয়—এটি একটি গভীর মানবিক ও নৈতিক প্রশ্নও। শিশুরা যখন ক্ষুধায় কাঁদে, বৃদ্ধরা যখন চিকিৎসা ছাড়া মারা যায়, তখন বিশ্ব মানবতা কোথায় দাঁড়িয়ে? জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেন, “মানবিক সহায়তা যেন অস্ত্র নয়, মানবতার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়—এটি আমাদের সবার দায়িত্ব।

গাজা আজ এক ভয়াবহ মানবিক সংকটের মুখোমুখি। খাদ্যকে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা একটি সভ্য সমাজের লজ্জা ও ব্যর্থতা। জাতিসংঘের শীর্ষ কর্মকর্তার বক্তব্য বিশ্ববাসীর চোখ খুলে দেওয়ার মতো। এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা, যাতে নিরীহ মানুষদের জীবন রক্ষার পথ তৈরি হয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *