জাপানে ২০২৪ সালে জন্মহার ৭ লক্ষের নিচে নেমে এসেছে:

জনসংখ্যা সংকট

২০২৪ সালে জাপানে প্রথমবারের মতো শিশু জন্মের সংখ্যা ৭ লক্ষের নিচে নেমে এসেছে, যা দেশের জনসংখ্যা সংকটকে আরও জটিল করে তুলছে। জেনে নিন এর কারণ ও ভবিষ্যৎ প্রভাব। ছবিঃ রেউটার্স

উদ্বেগে জাপান সরকার
জাপানে ২০২৪ সালে জন্মহার প্রথমবারের মতো ৭ লক্ষের নিচে নেমে এসেছে, যা দেশটির ইতিহাসে এক গভীর সংকেত। সরকার প্রকাশিত পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এই বছর দেশজুড়ে প্রায় ৬ লক্ষ ৮০ হাজার শিশু জন্মগ্রহণ করেছে, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ৪ শতাংশ কম। দীর্ঘদিন ধরে চলমান জনসংখ্যা সংকটের ধারাবাহিকতায় এই সংখ্যা আরও উদ্বেগ বাড়িয়েছে। জাপানের মতো একটি উন্নত অর্থনীতির দেশ যেখানে জনসংখ্যা ইতিমধ্যে বার্ধক্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে, সেখানে এমন একটি রেকর্ড পরিসংখ্যান জাতিকে বড় ধরনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছে।

জনসংখ্যা সংকটে জাপান: একটি দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা
জাপানের জনসংখ্যা সংকট কোনো নতুন বিষয় নয়। গত কয়েক দশক ধরে দেশটি ক্রমাগত কম জন্মহার এবং উচ্চ বার্ধক্য হারের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তরুণদের মধ্যে বিয়ে ও পরিবার গঠনের ইচ্ছা কমে গেছে, যার মূল কারণ জীবনের ব্যয়বৃদ্ধি, কর্মস্থলে চাপে থাকা জীবনধারা এবং ভবিষ্যতের নিরাপত্তাহীনতা। অনেক দম্পতি সন্তান নেওয়ার বিষয়ে দোদুল্যমান, কারণ তারা মনে করেন বর্তমান সমাজব্যবস্থায় একটি শিশুকে মানুষ করার খরচ এবং মানসিক চাপ অত্যন্ত বেশি। ফলে একদিকে যেমন শিশু সংখ্যা কমছে, অন্যদিকে সমাজে প্রবীণ নাগরিকের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। এতে স্বাস্থ্য খাত, পেনশন ব্যবস্থাসহ সমাজের প্রতিটি স্তরে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে।

জীবনের মানেই কি বদলে যাচ্ছে?
জাপানের তরুণ সমাজে জীবন সম্পর্কে ধারণা বদলে গেছে। আজকের তরুণ-তরুণীরা আগের মতো বিয়ে বা পরিবার গঠনে তেমন আগ্রহী নন। তারা নিজের ক্যারিয়ার, স্বাধীনতা এবং ব্যক্তিগত জীবনকে বেশি গুরুত্ব দেন। বিয়ের পরে নারী কর্মীদের ওপর সমাজ ও কর্পোরেট সংস্কৃতির চাপ, সন্তান নিলে কর্মজীবনে বাধা এবং উচ্চ জীবনযাত্রার ব্যয়—এই সকল বিষয়ের কারণে তরুণ প্রজন্ম পরিবার গঠনের ঝুঁকি নিতে চায় না। এ পরিস্থিতি শুধু অর্থনৈতিক নয়, এটি মনস্তাত্ত্বিক এবং সাংস্কৃতিক রূপও নিয়েছে, যা দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক পরিবর্তনের প্রতিফলন।

সরকারি পদক্ষেপ ও সেসবের সীমাবদ্ধতা
জাপান সরকার জন্মহার বাড়াতে বহু বছর ধরেই নানান উদ্যোগ নিয়েছে। শিশু জন্মের পর পরিবারকে আর্থিক সহায়তা প্রদান, মাতৃত্বকালীন ও পিতৃত্বকালীন ছুটি, কর্মস্থলে নমনীয়তা, এমনকি নিঃসন্তান দম্পতিদের জন্য কর ছাড়সহ অনেক পদক্ষেপ চালু রয়েছে। তবে বাস্তবতা হলো, এসব পদক্ষেপ শুধুমাত্র সমস্যার পৃষ্ঠচিত্র বদলায়, মূল সংস্কৃতিগত ও মনস্তাত্ত্বিক বাধাগুলো কাটিয়ে উঠতে সক্ষম নয়। সামাজিক সচেতনতা এবং তরুণদের মানসিক সুরক্ষা নিশ্চিত না করলে কেবল আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে জন্মহার বাড়ানো অসম্ভব।

২০২৪ জন্ম পরিসংখ্যান

ছবিঃ সিয়ানা

অর্থনীতিতে সম্ভাব্য বিপর্যয়
জন্মহার হ্রাসের ফলে জাপানের শ্রমবাজার সংকুচিত হয়ে পড়ছে। দেশের অধিকাংশ শিল্প ও সেবা খাতে কর্মী সংকট দেখা যাচ্ছে। ভবিষ্যতে এই সংকট আরও তীব্র হতে পারে, যার ফলে উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাবে, কর আদায়ের পরিমাণ কমবে এবং সরকারের পেনশন ও স্বাস্থ্যসেবা খাতে ব্যয় বেড়ে যাবে। বিশেষ করে প্রযুক্তি ও স্বাস্থ্য খাতে তরুণ কর্মীর অভাবের কারণে উদ্ভাবনী কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। এসব প্রভাব সরাসরি দেশের জিডিপি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে হ্রাস করতে পারে, যা বিশ্ব অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলবে।

অভিবাসন হতে পারে সম্ভাব্য উপায়
অনেক গবেষক ও নীতিনির্ধারক অভিবাসনকে সম্ভাব্য সমাধান হিসেবে দেখছেন। দক্ষ বিদেশি কর্মীদের আমন্ত্রণ জানানো এবং পরিবারসহ বসবাসের সুযোগ দিলে জাপানের শ্রমবাজার কিছুটা স্বস্তি পেতে পারে। তবে এই পথে এগোতে হলে সমাজে বহুজাতিক সংস্কৃতিকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হবে। বর্তমানে জাপান সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে অভিবাসী-বান্ধব নয়, যা বিদেশিদের স্থায়ীভাবে বসবাসে নিরুৎসাহিত করে। নীতিগত সংস্কার এবং জনসচেতনতা বাড়িয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠন করতে পারলে দীর্ঘমেয়াদে এই পথ কার্যকর হতে পারে।

বিশ্বজুড়েই উন্নত দেশগুলোতে জন্মহার হ্রাস একটি বড় প্রবণতা হিসেবে দেখা যাচ্ছে। দক্ষিণ কোরিয়া, ইতালি, স্পেনসহ অনেক দেশে জন্মহার উল্লেখযোগ্যভাবে কমছে। তবে জাপানের চিত্র আরও উদ্বেগজনক, কারণ এখানে একইসাথে জন্মহার কম ও বার্ধক্য হার বেশি। দক্ষিণ কোরিয়ায় জনসংখ্যা এখনো কিছুটা তরুণ, কিন্তু জাপানে গড় বয়স ৪৯ বছরের কাছাকাছি। ফলে এটি কেবল একটি সাময়িক সংকট নয়, বরং একটি দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক কাঠামো পরিবর্তনের সংকেত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *