নিঃশাতের এভারেস্ট জয়: আত্মপরিচয়, সাহসিকতা

নারী পর্বতারোহী

বাংলাদেশি পর্বতারোহী নিঃশাত হুসেইনের এভারেস্ট জয় ছিল কেবল একটি শারীরিক অভিযান নয়—এটি ছিল সামাজিক প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে আত্মপরিচয়, নারীর ক্ষমতায়ন এবং পরিবেশ সচেতনতার এক যুগান্তকারী বার্তা। পড়ুন তাঁর অসাধারণ যাত্রার পুরো গল্প। ছবিঃ ডেইলি এটার

পর্বতারোহণের গল্প, যা শুধুই শিখরে পৌঁছানো নয়

নিঃশাত হুসেইনের এভারেস্ট জয় ছিল কেবল একটি পাহাড় জয়ের ঘটনা নয়—এটি ছিল এক অন্তর্দ্বন্দ্বের, আত্মপরিচয়ের, এবং সামাজিক বাধাকে চ্যালেঞ্জ করে এগিয়ে যাওয়ার গল্প। একজন নারী হিসেবে এই ভূখণ্ডে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা যেমন কষ্টসাধ্য, তেমনি পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়ানোও ছিল জীবনের বহু বছরের সংগ্রামের চূড়ান্ত রূপ। তাঁর যাত্রা ছিল প্রতীকী, যেখানে প্রতিটি ধাপ ছিল সামাজিক প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা, নিজের প্রতি বিশ্বাসের প্রতিফলন, এবং নারীর সম্ভাবনার একটি বাস্তব উদাহরণ।

শৈশব থেকে স্বপ্ন দেখার সাহস

নিঃশাতের জীবন শুরু হয় এক সাধারণ শহুরে পরিবারে, যেখানে নারী শিশুদের জন্য স্বপ্ন দেখতে মানা না করা হলেও, বড় কিছু ভাবাকে নিরুৎসাহিত করা হতো। ছোটবেলা থেকেই প্রকৃতির প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসা ছিল। বই পড়তে পড়তে তিনি হিমালয়ের ছবি দেখতেন আর মনে মনে নিজেকে সেই বরফাচ্ছাদিত শৃঙ্গে কল্পনা করতেন। এই কল্পনার জগতে ঢুকেই তিনি স্বপ্ন দেখতে শিখেছেন—একদিন তিনি বাংলাদেশের পতাকা উড়াবেন বিশ্বের সর্বোচ্চ চূড়ায়। তাঁর এই কল্পনা একসময় পরিণত হয় বাস্তব লক্ষ্য হিসেবে।

পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম

একজন নারী হিসেবে পর্বতারোহণের স্বপ্ন পূরণ করা কখনোই সহজ ছিল না। নিঃশাতকে সামলাতে হয়েছে নানা রকম প্রতিবন্ধকতা—মাঝেমধ্যে পরিবারের আর্থিক অক্ষমতা, কখনো সমাজের তাচ্ছিল্য, আবার কখনো নিজের মানসিক দ্বন্দ্ব। পর্বতারোহণ একটি ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ প্রক্রিয়া। তবুও, নিঃশাত কখনো থেমে যাননি। নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি ফ্রিল্যান্স কাজ করেছেন, অংশ নিয়েছেন বিভিন্ন কর্মসূচিতে অর্থ সঞ্চয় করার জন্য। এই সবই ছিল তাঁর উচ্চতর প্রস্তুতির অংশ। তাঁকে কেউ সুযোগ দেয়নি, তিনি নিজের জন্য সেই সুযোগ তৈরি করেছেন।

নিঃশাতের এভারেস্ট অভিযান ছিল বহু বছরের কঠোর প্রশিক্ষণ, মানসিক দৃঢ়তা এবং শারীরিক সহনশীলতার ফল। তিনি ভারত ও নেপালের বিভিন্ন পর্বতশৃঙ্গে অনুশীলন করেছেন, উচ্চতাজনিত সমস্যার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে শেখেছেন, এবং শূন্য ডিগ্রির নিচের তাপমাত্রায় বেঁচে থাকার কৌশল আয়ত্ত করেছেন। শুধু শারীরিকভাবে নয়, মানসিকভাবে নিজেকে প্রস্তুত রাখাটাই ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ক্লান্তি, ভয়, নিঃসঙ্গতা—সবকিছুর বিরুদ্ধে নিজের মনকে শক্ত রাখা নিঃশাতের সাফল্যের অন্যতম চাবিকাঠি।

পতাকা ওড়ানোর দৃশ্য

২০২৪ সালের এক ঝলমলে সকালের ঠিক আগে, নিঃশাত যখন এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছালেন, তখন তাঁর চোখে জল ছিল। সেই মুহূর্তে তিনি কেবল বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকাই ওড়াননি, বরং নারীর স্বপ্ন, সাহস আর সম্ভাবনার এক প্রতীক তুলে ধরেছেন সারা বিশ্বের সামনে। সেই শূন্যের নিচে হিমেল বাতাসে দেশের পতাকা ওড়ানো ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে আবেগঘন মুহূর্ত। এটি ছিল একটি ব্যক্তিগত জয়, একটি জাতীয় গর্ব, এবং একটি আন্তর্জাতিক বার্তা—নারীরা চাইলে পারে।নিঃশাতের অভিযান কেবল ব্যক্তিগত অর্জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি তাঁর এই যাত্রাকে নারীর ক্ষমতায়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। বিভিন্ন স্কুল-কলেজে গিয়ে তিনি বক্তব্য রাখেন, তরুণীদের উৎসাহিত করেন বড় স্বপ্ন দেখার জন্য। তাঁর মতে, “নারী মানেই দুর্বল নয়। নারী মানেই বাধা নয়। নারী মানেই এক সম্ভাবনার নাম।” তাঁর গল্প আজ অনেক তরুণীর মনে সাহস জোগায়, অনুপ্রেরণার বাতিঘর হয়ে ওঠে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *