বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ন্যায়সঙ্গত ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি অপরিহার্য

দরিদ্র জনগোষ্ঠী

খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের জন্য শুধু উৎপাদন নয়, প্রয়োজন ন্যায্য বণ্টন ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা দিয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ মতামত। ছবি: টিবিএস

খাদ্য নিরাপত্তা—শুধু উৎপাদনের বিষয় নয়

বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। তবে বাস্তবতা হলো, শুধু খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিই এই সমস্যার পূর্ণ সমাধান নয়। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ আশাব্যঞ্জক হলেও সমাজের এক বিশাল অংশ এখনও পর্যাপ্ত ও পুষ্টিকর খাদ্য থেকে বঞ্চিত। এর প্রধান কারণ হলো এই খাদ্যের সঠিক বণ্টন ও মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতার অভাব। একটি পরিবার খাদ্য চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হলে কেবল অভাব নয়, স্বাস্থ্যঝুঁকি, অপুষ্টি, শিশু বিকাশে প্রতিবন্ধকতা এমনকি সামাজিক অস্থিরতা পর্যন্ত সৃষ্টি হতে পারে।

ক্রয়ক্ষমতা—নিরাপত্তার মূল ভিত্তি

খাদ্য নিরাপত্তার মূল ভিত্তির একটি হলো জনগণের ক্রয়ক্ষমতা। খাদ্য বাজারে উপলব্ধ থাকলেও যদি সাধারণ মানুষের পক্ষে তা কেনা সম্ভব না হয়, তবে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন সম্ভব নয়। দেশে নিন্মআয়ের মানুষ বিশেষ করে দিনমজুর, ক্ষুদ্র কৃষক ও শ্রমজীবী জনগোষ্ঠী প্রতিদিনই খাদ্যের সংকটে পড়ছে। বাজারে চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ায় তারা আর্থিকভাবে চাপে পড়ে। অপরদিকে মজুরি ও আয়ের হার সে অনুপাতে বাড়ছে না। ফলে বিপুল জনগোষ্ঠী প্রতিনিয়ত অপুষ্টিতে ভুগছে এবং এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও মারাত্মক হুমকি তৈরি করছে।

বণ্টন ব্যবস্থার অসাম্য

দেশে খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থায় দীর্ঘদিন ধরেই অসাম্য ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। সরকারি সহায়তার নানা কর্মসূচি যেমন খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি, টিসিবির ট্রাকসেল, বা রেশনিং ব্যবস্থা অনেক সময় সঠিক মানুষদের কাছে পৌঁছায় না। তালিকা তৈরির অনিয়ম, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য—এসব কারণে প্রকৃত দরিদ্ররা বঞ্চিত হন। খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে এ ধরণের দুর্বল ও পক্ষপাতদুষ্ট ব্যবস্থাকে সংস্কার করতে হবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ, নারী, শিশু ও প্রবীণদের বিশেষভাবে বিবেচনায় এনে খাদ্য বিতরণ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

 ক্রয়ক্ষমতা

ছবি: টিবিএস

শহর বনাম গ্রামে খাদ্য প্রাপ্তির ব্যবধান

বাংলাদেশে শহর ও গ্রামভিত্তিক খাদ্য প্রাপ্তির মধ্যে বড় ধরনের বিভাজন রয়েছে। শহরে খাদ্যের দাম বেশি হলেও সেখানে বিকল্প উৎস ও সরবরাহ ব্যবস্থা অপেক্ষাকৃত ভালো। কিন্তু গ্রামে দরিদ্র জনগণ বাজারে খাদ্যসামগ্রী না পেয়ে হয়ত একবেলা না খেয়ে থাকে। কৃষকের উৎপাদিত পণ্য বিক্রয়ের উপযুক্ত ব্যবস্থা না থাকায় তারা ন্যায্য মূল্য পায় না, অথচ ভোক্তাদের কাছে সেই খাদ্য পৌঁছাতে গিয়ে দাম বেড়ে যায় কয়েকগুণ। ফলে উৎপাদন এলাকা হয়েও গ্রামে খাদ্যের সংকট দেখা দেয়। এই ব্যবধান ঘোচাতে হবে সঠিক অবকাঠামো, যোগাযোগব্যবস্থা এবং ন্যায্য বাজার তৈরির মাধ্যমে।

সরকারের নীতিমালা ও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ

খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে সরকারের পক্ষ থেকে একটি সমন্বিত ও টেকসই খাদ্য নীতি গ্রহণ জরুরি। শুধু উৎপাদনের ওপর জোর না দিয়ে খাদ্যের প্রাপ্যতা, প্রবেশযোগ্যতা এবং পুষ্টিমূল্য—এই তিন দিককে গুরুত্ব দিতে হবে। দরিদ্রদের জন্য বিশেষ ভর্তুকি, খাদ্য নিরাপত্তা কার্ড, স্কুল ফিডিং কর্মসূচি এবং সমাজকল্যাণ কার্যক্রমের সম্প্রসারণ প্রয়োজন। কৃষকদের উৎসাহিত করতে সাবসিডি ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা চালু করতে হবে। এছাড়া দুর্যোগকালে জরুরি খাদ্য মজুদ এবং তা দ্রুত সরবরাহের জন্য আধুনিক গুদাম ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

নাগরিক সচেতনতা ও সামাজিক দায়িত্ব

খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কেবল সরকার নয়, সমাজের সব শ্রেণির মানুষকে ভূমিকা রাখতে হবে। বিত্তবানদের খাদ্য অপচয় কমানো, বেসরকারি সংস্থাগুলোর ত্রাণ কার্যক্রমে স্বচ্ছতা আনা এবং সামাজিক দায়িত্ব পালনের মনোভাব গড়ে তুলতে হবে। সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করে খাদ্যের প্রতি মূল্যবোধ গড়ে তুলতে পারলেই প্রকৃত অর্থে একটি নিরাপদ ও ন্যায়ভিত্তিক খাদ্যব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।

ভবিষ্যৎ ভাবনা ও পরিকল্পনা

আগামী দিনের বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা কেবল খাদ্য প্রাপ্তির প্রশ্ন নয়—এটি টেকসই উন্নয়নের অংশ। জলবায়ু পরিবর্তন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, কৃষিজমি হ্রাস, এবং নগরায়ণের চাপে ভবিষ্যতে খাদ্য সংকট আরও জটিল হতে পারে। তাই এখন থেকেই খাদ্য উৎপাদনের পাশাপাশি সমাজে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা, সামাজিক নিরাপত্তা বলয় শক্তিশালী করা, এবং জনগণের জীবনমান উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া জরুরি। এটি একটি সম্মিলিত ও দায়িত্বশীল প্রয়াসের মাধ্যমেই সম্ভব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *