বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে স্থায়ী কমিশন গঠনের চিন্তায় সরকার

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে এবং বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে সরকার একটি স্থায়ী কমিশন গঠনের চিন্তা করছে। এতে ভোক্তা ও ব্যবসায়ীদের মতামত ও সরকারের প্রস্তুতি নিয়ে বিশদ আলোচনা। ছবিঃ প্রথম আলো
বাজার সিন্ডিকেট: মূল্যবৃদ্ধির পেছনের অদৃশ্য শক্তি
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বাজার সিন্ডিকেট একটি বহুল আলোচিত ও জটিল সমস্যা হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যমান। প্রতিদিনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য— যেমন চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ ও চিনি—এসবের দামে হঠাৎ করে অস্বাভাবিক উর্ধ্বগতি দেখা দিলে সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়ে। মূলত কিছু প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকের গোপন আঁতাতের ফলে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয় এবং চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম দেখিয়ে দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়। সরকারের বিভিন্ন সময়ের অভিযান ও মনিটরিং সত্ত্বেও এই সিন্ডিকেট বারবার একই কৌশলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। বিষয়টি শুধু ভোক্তাদের দুর্ভোগই বাড়ায় না, বরং পুরো বাজার ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা হ্রাস করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সমস্যা নির্মূল করতে হলে একক বা সাময়িক পদক্ষেপ নয়, প্রয়োজন একটি সুসংগঠিত, স্থায়ী ও কার্যকর কাঠামো।
স্থায়ী কমিশনের দাবি ও প্রয়োজনীয়তা
বর্তমান বাস্তবতায় বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে একটি স্থায়ী, স্বাধীন ও দক্ষ কমিশন গঠনের দাবি ক্রমেই জোরালো হয়ে উঠছে। অর্থনীতি বিশ্লেষক, গবেষক, সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, এ ধরনের একটি কমিশন না থাকলে বাজারে ন্যায্য প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এমন একটি কমিশন গঠিত হলে তা বাজার পরিস্থিতির গভীর বিশ্লেষণ করতে পারবে, অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণ খুঁজে বের করতে পারবে এবং সংশ্লিষ্ট সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হবে। কমিশনের কাজ হবে নিয়মিত তথ্য সংগ্রহ, বাজার পর্যবেক্ষণ, অভিযোগের তদন্ত এবং গণশুনানি পরিচালনা। মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, এমনকি প্রতিবেশী ভারতেও এ ধরনের কমিশন সফলভাবে কাজ করছে এবং বাজারে স্বচ্ছতা ও প্রতিযোগিতা প্রতিষ্ঠায় তা কার্যকর ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশে এ ধরনের একটি কমিশন বাজার ব্যবস্থার দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি ও চলমান উদ্যোগ
সরকারি সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে যে, বাজার ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনতে ও সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে একটি স্থায়ী কমিশন গঠনের প্রাথমিক আলোচনা ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, প্রতিযোগিতা কমিশন এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের প্রতিনিধিরা বিষয়টি নিয়ে নিয়মিত বৈঠক করছেন। কমিশনটি গঠিত হলে তা কী ধরণের ক্ষমতা পাবে, কীভাবে তদন্ত পরিচালনা করবে, এবং কীভাবে রিপোর্ট প্রকাশ করবে— এসব বিষয় নিয়ে একটি খসড়া নীতিমালা প্রস্তুত করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। সরকার বর্তমানে কিছু স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ— যেমন অভিযান, জরিমানা ও বাজার মনিটরিং চালালেও, এই ব্যবস্থা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাৎক্ষণিক ও অপর্যাপ্ত প্রমাণিত হচ্ছে। ফলে, একটি শক্তিশালী ও স্বাধীন কমিশনের প্রয়োজনীয়তা প্রতিনিয়ত উঠে আসছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে এখনও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না আসায়, এটি শুধু প্রস্তাবনাতেই সীমাবদ্ধ রয়েছে।
ভোক্তা ও ব্যবসায়ী সমাজের প্রতিক্রিয়া
বাজার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে স্থায়ী কমিশন গঠনের প্রস্তাব নিয়ে সমাজে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন ভোক্তা অধিকার সংগঠন যেমন ক্যাব (ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ সংস্থা) মনে করছে, দীর্ঘদিন ধরে সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের নামে শুধু লোকদেখানো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যার বাস্তব ফলাফল ছিল শূন্যের কোঠায়। তারা বলছেন, একটি স্বাধীন কমিশন গঠিত হলে তা বাজারে ন্যায্যতা ফিরিয়ে আনবে, যার ফলে সাধারণ জনগণ উপকৃত হবে। অন্যদিকে ব্যবসায়ী সমাজ থেকেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া এসেছে। কিছু ব্যবসায়ী নেতা মনে করছেন, সরকার যদি সত্যিই নিরপেক্ষভাবে বাজার মনিটর করতে চায়, তবে তারা সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। তবে তাদের শঙ্কা হলো, এই কমিশন যেন ব্যবসায়ীদের হয়রানির মাধ্যম না হয়ে ওঠে। তাই তারা চায়, কমিশনটি হবে পেশাদার, স্বচ্ছ ও পক্ষপাতহীন।

ছবিঃ ডেইলি ষ্টার
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা ও বাস্তব চ্যালেঞ্জ
যদি সরকার একটি কার্যকর ও স্বাধীন কমিশন গঠনে আন্তরিক হয়, তবে এটি হতে পারে বাংলাদেশের বাজার ব্যবস্থার জন্য এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তবে কমিশনের সফলতা অনেকখানিই নির্ভর করবে তার ক্ষমতা, স্বাধীনতা, দক্ষ জনবল এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার উপর। অনেক সময় দেখা যায়, বিভিন্ন সংস্থা গঠনের পরও সেগুলো কেবল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকে বা রাজনৈতিক প্রভাবে কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। তাই এই কমিশন যেন শুধুমাত্র বাহ্যিক প্রদর্শনী না হয়ে উঠে, সেজন্য আইনি কাঠামো, বাজেট, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে জনগণকে সচেতন করতে হবে যাতে তারা কমিশনের কাছে অভিযোগ করতে সাহস পায়। গণমাধ্যমের ভূমিকা, সামাজিক আন্দোলন এবং প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাজার পর্যবেক্ষণের আধুনিক পদ্ধতি প্রয়োগ করলেই এই কমিশন বাস্তব পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবে।